পরিচালক বাক্
Wednesday, April 13, 2016
বাংলা আজ পৃথিবীর সপ্তম
বৃহত্তম ভাষা। আন্তর্জাতিক দরবারে তার মর্যাদা কারও চেয়ে কম নয়।
অবিশ্যি এতে দৃপ্ত হওয়ার কারন আছে, অহমিকার সুযোগ নেই। সংখ্যার আধিক্য
উৎকর্ষের মাপকাঠি হতে পারে না। বিশেষ করে প্রশ্ন ওঠে, আন্তর্জাতিক দরবারে আমরা কোন
বাংলার কথা বলব? কৃষ্ণনগরের বাংলা, বাঁকুড়ার বাংলা, পুরুলিয়ার বাংলা, কোচবিহারের
বাংলা, চট্টগ্রামের বাংলা নাকি মৈমনসিংহের? মৈমনসিংহের বাংলা আর কৃষ্ণনগরের বাংলার
আপাত পার্থক্য তো সামগ্রিক বাংলা ভাষা আর ওড়িয়া ভাষার ভেদের চেয়ে খুব কম নয়! এবং
এর মধ্যেই প্রতি মুহূর্তে জন্মাচ্ছে আমাদের বাংলা কবিতা। বাংলা ভাষায় যেমন বিবিধের
মধ্যে ঐক্যের সুযোগ আছে, তেমনই তার অনেক আঞ্চলিক আর একটিমাত্র মান্যতাপ্রাপ্ত
রূপের মধ্যে সংঘাতের সুযোগও কিন্তু আছে। প্রতিষ্ঠানের চাপিয়ে দেওয়া ভাষায় যে বাংলা
কবিতার ইতিহাস তৈরি করা হয়, এই কারনেই কি আজ বাংলা কবিতা বিচ্ছিন্নতার শিকার
হচ্ছে, যে অভিশাপটা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষাকে ঠিক এভাবে বইতে হয় না? পুরুলিয়ার
ভাষায় লেখা কবিতা বাংলা কবিতা হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতাই পাবে না, সে
কৃষ্ণনগরের ভাষাকে অবলম্বন করতে বাধ্য, অথবা তাকে আঞ্চলিক কবিতা হিসেবে ব্রাত্য ও
বঞ্চিত হয়ে থাকতে হয়।
বাংলা কবিতা আজ
তর্কাতীতভাবেই আন্তর্জাতিক, কারন ভারত ও বাংলাদেশ এই দুটি রাষ্ট্রে তার বিস্তার।
এ-রকম ভাবার কোনো কারন কি আছে যে, বাংলাদেশে কবিতার মাটি বেশি উর্বর আর এই
পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে গদ্যসাহিত্যের ফলন বেশি স্বাভাবিকভাবে হয়?এটা অস্বীকার করার অবিশ্যি
উপায় নেই যে, আমাদের ভাষার অগ্রগণ্য কবিদের অধিকাংশই পূর্ববঙ্গজাত। এ হয়ত নিছক
সমাপতন। তবে এটাও ঘটনা, পূর্ববঙ্গের কথ্য বাংলাটি অনেক বেশি লালিত্যময় ও লিরিকাল,
তার প্রাণও হয়তো বেশি মাটিছোঁয়া, এবং পশ্চিমবঙ্গের স্বীকৃত ভাষাটি ব্রিটিশ ইংরেজির
মতোই পাথুরে যুক্তি মেনে চলে, এবং সেই যুক্তি তার বিভিন্ন কথ্য রূপকেও প্রভাবিত
করে, ফলে গদ্যটাই ভালো হয় এখানে। আমরা যে বাংলাকে অবলম্বন করেছি
সে কিন্তু ইংলিশ-আশ্রয়ী। ইংরেজির যুক্তিকাঠামো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা
কবিতাতেও আশা করা হয়, তবেই সে পন্ডিতদের ছাড়পত্র পায়। অন্যথায় তাকে লোকসাহিত্যের
কোটায় ফেলে দেওয়া হয়। লোকসাহিত্যের আভিজাত্য এবং বুদ্ধিমত্তাকে খুব বেশি মান্যতা
দেওয়া হয় না, তার প্রধানত আবেগের ছাড়পত্র থাকে।
পৃথিবীর অন্যতম প্রধান
এবং আন্তর্জাতিক ভাষায় লিখিত হয়েও তাই ২০১৬-র প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা কবিতার
সর্বাঙ্গে একরকমের ভ্রান্তি ও কৃত্রিমতা লেগেই আছে, যা তাকে সাধারণের কাছে যেতে
দেয় না, আবার তাকে বিশ্বজনীন গুরুত্ব পেতেও বাধা দেয়। এটা এই ২০১৬-র বাস্তবতা। বাংলা
কবিতার প্রাতিষ্ঠানিকতা বাংলাভাষার স্বাভাবিক জায়মানতাকে যথাসাধ্য আটকে রেখেছে
আজও। আজও একজন কবির যুক্তির বাইরে পূর্ণচ্ছেদ বসানোর অধিকার স্বীকার করা হয় না,
কারন সেই অধিকারের মাপকাঠি উপনিবেশসূত্রে পাওয়া ব্রিটিশ যুক্তিকাঠামো। ভারতীয়
আইনব্যবস্থা যেমন আজও ব্রিটিশ আইনকেই কিছু রদবদলের মাধ্যমে মেনে চলছে, ভারতীয় উকিল
যেমন আজও ব্রিটিশ উকিলের পোশাকেই শোভিত, বাংলা কবিতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি থেকেও
ব্রিটিশ যুক্তিকে আজও মুছে ফেলা যায়নি। সেই তাগিদও খুব কম কবির ক্ষেত্রেই দেখা
গেছে, দেখা যাচ্ছে। এর পিছনে একটা বিরাট কারন হল বাঙালি কবির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং
ভ্রমণপিপাসা ও দেশপ্রেমের অভাব। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কোনো বাঙালি
কবিই দেশের মাটি কপালে নিয়ে পৃথিবীকে জয় করার স্পর্ধা দেখাননি। রবীন্দ্রনাথ
আন্তর্জাতিক হয়েছিলেন কারন সেটার জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টা উনি করেছিলেন। তাঁর পরে আর
কেউ ওই আকাঙ্ক্ষা দেখাননি। যারা দেখিয়েছেন তাঁদের সাধ্যে কুলোয়নি। বিদেশে বাস করেও
তাঁরা শুধুই কলকাতার কবি হয়ে থেকে গেছেন।
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক বাক্
পরিচালক বাক্