• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় ও তুষ্টি ভট্টাচার্য
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - সোনালী চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস
  • ধারাবাহিক উপন্যাস


    বঙ্কিমচন্দ্র


    অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত

Wednesday, April 13, 2016

বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত

.....বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত.....
 (প্রকাশিত গ্রন্থ- -“পরবাসী”, “সাক্ষাৎকার’, “কবিতার শব্দ ও শব্দভ্রম”, “কব্যবীজ ও কমলকুমার মজুমদার”)
কবি বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম লাইনটা ছিল-“ এই বুকে সবই আছে।বন্ধু শুনে হাসে; বলে, ভালো।“ আর ২৯ শে নভেম্বর গণশক্তি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনে একটি যোগাযোগের (“অশোক রক্ষিত, বি-১/১৫৫ কংগ্রেস রোড়,কল্যানী,নদীয়া)” নিচে খুঁজে পাওয়া গেল অপর এক আকুতি যা প্রয়াত কবি বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের স্ত্রীর সাহায্যের আবেদন মানসিক প্রতিবন্ধী পুত্রের হোমে থাকার খরচ চালানোর জন্য। অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম এই দুটো বাক্যের মধ্যেকার মাটি সরালে, কফিন ভাঙলে, হাড়গোড় কঙ্কাল খুঁড়লে ঠিক কি পাওয়া যেতে পারে! জীবন সম্পর্কিত একটি অবশ্যম্ভাবী বাছাইয়ের কথা? একজন শিল্পী ,একজন স্রষ্ঠা জল বাতাসের মত চুরি হয়ে যেতে পারেন জেনেও কেন সৃষ্টি করবেন, কেন লিখবেন কবিতা,কেন চারিদিকের পণ্যের মন্ডে বসেও তাঁর শিল্পিত সেলাইয়ের ফোঁড়গুলি পড়বে প্রাণমন্ডলের দিকে-তার কথা? ঠিক এ প্রশ্নটিরই নিরুচ্চরিত বয়ান লুকিয়ে রয়েছে বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের মত কবিদের আত্মনাট্যের আবহে । “বাকে”র “হারানো কবিতার” মধ্যে দিয়ে কেবল কোনো অচর্চিত কবি বা কবিতাকে তুলে ধরা আমাদের কাজ নয়, বরং আমাদের প্রকৃত উদ্দেশই হল বারবার মনে করানো সে সমস্ত কবিদের যারা তাঁদের জীবনব্যাপী অনুধ্যাননার মধ্যে দিয়ে খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শিল্পের-‘স্থিতি নেই, স্মৃতি আছে’। বীরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-“শিয়রে তো কেউ নেই।একমাত্র রোদ্দুরের স্মৃতি/ ছায়া হয়ে পড়ে আছে।টেবিলের ওষুধ,গ্লাসে জল,/এবং সস্তায় কেনা শুকনো ফুল,কিছু ঠান্ডা ফল।/ আর এই চার দেয়ালে দুপুরের আশ্চর্য নিভৃতি। “এই ব্যক্তিক কথন কিন্তু আদতে একটি নৈর্ব্যক্তিক সময়োত্তীর্ণ কথাপাঠের সুযোগ করে দিচ্ছে আমাদের। হয়ত জীবনের খন্ড মূর্হুতগুলো থেকে এই সত্যের ভেতরই ঢুকে পড়তে চেয়েছিলেন বীরেন্দ্রনাথ আর তাই তো তিনি বন্দী অসহায় অভিজ্ঞতাকেও ডেকে নিয়েছিলেন কত অনায়াসে-“ কবে হে অভিজ্ঞতা,সরকারী চাকরি ছেড়ে/ শরতকালীন, একাদোকা, ফোতো-বাবুদের মতো বেরিয়ে পড়বে?”-“পরবাসী” কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায় আমরা জীবন সম্পর্কে বীরেন্দ্রনাথের অদ্ভুত বিষাদ লক্ষ্য করতে পারি। কোথাও তিনি বলছেন-“ সমগ্র সত্তার মধ্যে পাঁচ আঙুলের সমাহার/হাতের মুঠোয় তবু কতটুকু ধরে;/ধরলো না তৃণের দেহ,বালিবিম্ব,সমুদ্রের মুখ;/সুপ্তি থেকে,স্বপ্ন থেকে,জাগ্রত মৃত্যুর জ্বালা থেকে/ একে একে ঝরে পড়ছে স্থিতির প্রবল অহঙ্কার।“ কিংবা কোথাও তাঁর স্বীকারোক্তি-“ দূর থেকে যে দৃশ্যকে তৃষ্ণার পানীয় বলে জানি/নিকটে সেই তো এক কৃত্রিম কানন।“ কিন্তু এই বিষাদ, শোকাবহ কেবল তাঁর কাব্যিক প্রসাধন নয় বরং এই নির্জনতা, নির্লিপ্তি, এই অভিযোগহীন সমাধি পাঠককে এক নতুন উন্মোচনের জগতে নিয়ে চলে। সেখানে নৈরাশ্যবোধের মধ্যে দিয়ে কেবল শুন্যতা নয় বরং তিনি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে এক নিঃস্ব বাড়ি এঁকেছেন,এঁকেছেন ‘অল্প আঁচের নির্জন বোঝাপড়ার কথা’। প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্যের মতে এই সেই না ঘুমে না জাগরণের ঠিকানা, এই সেই কবির অনিষ্ট বয়ানের উপাদান যা পাঠকের পরিচিত অভিজ্ঞতার জগতকে পুর্নগঠিত করে পৌঁছে দেয় কবির অনুবিশ্বে।

পঞ্চাশের দশকের উজ্জ্বল কবি বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কবিতা এককথায় আত্মঅভিজ্ঞ থেকে আত্মসত্যের দিকে এক নতুন পরিসর বলা যেতে পারে। শব্দের মধ্যে যে শব্দাতিগ পরাবয়ন রয়ে গেছে তাই আমাদের জানালেন বীরেন্দ্রনাথ এবং তাঁর সমসময়ে দাঁড়িয়ে একেবারে মৌলকবিতার অন্বেষণ করেছিলেন তিনি। বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কাব্যগ্রন্থ “সাক্ষাৎকার’ পড়ে অগ্রজ কবি যুগান্তর চক্রবর্ত্তী মন্তব্য করেছিলেন-“ আমাদের শব্দাশ্রয়ী Communication” এর যাবতীয় অভ্যাসকে বিপর্যস্ত করে তুমি যেন এখন কবিতাকে কবিতারই বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাইছো। যেন এ কারো ‘লেখা’ নয়, যেন ‘কবি’ নেই, এমনকি রচনাকারী কোনো ব্যক্তিমানুষও সম্পূর্ণ উহ্য বা গৌণ হয়ে আছে। যেন বাস্তবতার অপর দিক থেকে কিছু অভিজ্ঞতা , কারো শাসন বা আজ্ঞা না মেনেই আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, যদিও ধরতে পারছি না কী সেই অভিজ্ঞতা । হয়তো Anti-poetry নিয়ে এ এক চরম ও সর্বাত্মক পরীক্ষা, যা বাংলা কবিতায় এর আগে হয়নি’-এবং তাঁর মৌল কবিতায় যতিচিহ্নের ব্যবহার থেকে শুরু করে প্রকরণবিলাস,এমন সব একাধিক মূর্হুতের মূল্যায়ণ সম্ভব। বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কবিতার ঐতিহ্য নিয়ে প্রাবন্ধিক দেবাশিষ তরফদার লিখেছেন-.”তাঁর কবিতায় ইমেজের রূপান্তরের দিকটা চমৎকার। যেমন-‘নবীনেরা, যেখানে সবুজ ঘাসে মেরুণ ডিউজবলের কঠিনকে লুফতে চায়,/আর নবীনা, তাকেই – তার কোলের ভিতর রঙ-মিলিয়ে/আলতো দেয় টান’।তাঁর সামগ্রিক উত্তরপর্বের রচনার অনুষঙ্গই হল  building block। তাঁর রচনার একক আর শব্দ নয়, অসংখ্য উল্লেখ যার সঙ্গে নানা স্মৃতি,নানা অনুষঙ্গ জড়ানো। এদের সমষ্টিতে নয়,বরং বলা যায় মিলিত অভিঘাতে এক একটি ভাবখন্ডের সৃষ্টি। এই কবিতাগুলি বাক্যের নয় ,ভাবখন্ডের মালা।অনুভব-কণাগুলিকে,সরলরেখায় নয়,বহুতল গঠনশৃঙ্খলায় সাজিয়ে,কবি তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তাঁর ভাবসৌধ,তাঁর বহুকৌণিক হীরকপ্রকাশ ।

একদিকে তিনি যেমন জীবনকে এড়িয়ে যেতে চাননি অন্যদিকে তেমনি কবিতার হাত ছাড়েননি ফলে এ দুইয়ের দ্বন্ধে ভরপুর পর্যটন তাঁর কবিতায় , ফলে চেনা পৃথিবীর আকর থেকে আবর্তসঙ্কুল থেকে ক্রমাগত চৈতন্যের অতলটান অনুভব করেছিলেন বীরেন্দ্রনাথ।  তিনিই তো বলেছিলেন-‘ দৃষ্টি প্রদীপের আলো সবই তো দেখায়, অদৃশ্য যা/ তারই জন্য আমাদের চোখের, মনের ক্ষুধা জ্বলে।“ তিনিই তো বলেছিলেন-“ক্রমশ সুনীল আলো ফিকে হয়ে এলো এইখানে;/ এখানেই আন্তরিক কোনো আলো অথবা আগুন/ কিছুই জ্বলবে না আর বহুকাল, অথচ অতীতে/একবার দরজা খুলে দিলে কতো রোদ/পড়ে থাকতো এইসব বিক্ষত পাষাণে;”। এই যে অসম্পূর্ণতার মাঝেও চুপি চুপি সম্পূর্ণতার নিবিড় দরজা খোলা, এই যে পরিচয়ের মাঝেও অপরিচয়কে চিনতে চাওয়া এখানেই একান্ত নিজস্ব বীরেন্দ্রনাথ। আবার বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, কবি বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কবিতায়  ব্যক্ত ও অব্যক্ত,বোধ ও জিজ্ঞাসার আন্ত;সম্পর্কের পাঠ ও পরিধি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলছেন- “ তাঁর কবিতায় যেন কর্তা থাকে না কেউ। তিনি সম্বোধন করেন ঃ- ‘লক্ষ্যগোচর’, ‘আদিঅন্তহীন’, ‘উঁচু’, ‘অনুন্নতশ্রেনী’, ‘বন্ধুর আঁকাবাঁকা’, ‘দিকদিগন্ত’-এমন সব প্রিয়জনদের। তাঁর জগতে আত্মীয় কোনো ‘মানুষ’ যেন নেই কোথাও। তাঁর জগতে শুধু এরাই ঃ- ‘সংকেত’, ‘আবহমানতা’, ‘নয়নাভিরাম অস্ত’, ‘নিরপেক্ষতা’, ‘রনোন্মদনা’ ‘অন্তরাত্মার ছাপ’, ‘মুদ্রনপ্রমাদ’, ‘হৃধয়হীনতা’, ‘তুর্কীনাচন’ ,’জোনাকি-জগত পারিপার্শ্ব’, ‘নাবালক ঝর্ণা’। যেন এক কন্টকময় জগতে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত থেমে গিয়ে এই জীবনের খেলা ও সহায়হীনতার চাপ সমানভাবে টের পান তিনি আর  ঐ রক্তছিন্ন কষ্টকে সাময়িকভাবে ভুলে যেতে যেতে তাঁর চোখে পড়ে ‘শঙ্খের আঙটি পরা আঙুল’ এবং ‘গোড়ালিরা নাচে’-এমন চকিত দৃশ্য যা তার কবিতায় অনুষঙ্গ হয়ে আসে- কিছু যে বলে তা বোঝা যায়-দৃশ্য হিসেবেও আমরা দেখে ফেলি তেমনকিছু। খুব চেনা মন্ডলে ঘোরাফেরা করে তাঁর অনুষঙ্গগুলি, কিন্তু তবু খুবই অচেনা তাঁর ভাষা। এমন কথা বীরেন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে যেভাবে বলতে পারছি, সমসাময়িক অন্য কারো সম্পর্কে সেভাবে বলা যাচ্ছে না যেন”।

কবিতার কোনো ভূগোল হয়না আর তাই তাকে বেঁধে রাখা যায়না কাঁটাতারে। আজ বাংলা ভাষাচর্চা সাহিত্যচর্চা প্রসংগ উঠলে উঠে আসে কলকাতা কেন্দ্রিক ভাষামোড়লদের শিলায়িত সমাজের রঙিন পসরার তুমুল পরিহাস। কিন্তু কবিতাকে কে আটকাবে?আর তাই বরাক উপত্যকার বাংলা কাব্যসাহিত্যের অন্যতম মৌলিক কবি হয়েও বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত শরণার্থী শিবির টপকে কত অনায়াসে ঢুকে পড়েছেন জীবনবাহিত এক বড় জীবনে। বাংলা কবিতা বলতে যাঁরা আজও কেবল মহানগর কেন্দ্রিক ভাষিক ক্লীবতা বোঝেন তাদের কাছে অবশ্যই শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, উদয়ন ঘোষ, বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য বা বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের মত বৃহত্তর আসাম উপত্যকার প্রতিনিধিত্বকারীদের বাংলা সাহিত্যের সৌখিন নৈরাজ্যে নতুন উপনিবেশ গড়ে তোলা যথেষ্টই পীড়নের বিষয়। কিন্তু সৌন্দর্যতো সংক্রামিত হবেই, প্রান্তীয় ভূগোল থেকেই গড়ে উঠবে নতুন নতুন চেতনার দ্বীপ। আর বাস্তুচ্যুত বাঙ্গালীর শেকড়ের টানও সেখানে প্রিন্টিং প্রেসের দেশগ্রাম ছাড়িয়ে রয়ে যাবে নিঁখুত কালো ও লাব্যণময় হয়ে। ১৯৫৯ এ বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পরবাসী’ স্বয়ং কোত্থাও যেন এক ফেলে আসা ভূগোল পরিভ্রমণের দস্তাবেজ। অনবদ্য প্রবাহমাণ তিনি , তাঁর ‘দেশের বাড়ি’, ‘চোখের খিদে’ কিংবা ‘মুড়িমুড়কি চাওয়া’ সবেতেই যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে চেতনার উদ্বাস্তু প্রব্রজনের সমান্তরাল প্রতিবেদন। উত্তর পূর্বাঞ্চলের ঘন আরণ্যিক কৈশোরকালের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে গেছেন কবি । শব্দের মধ্যে দিয়ে তাঁর ‘অনেক বেড়ানো’তে কোথাও যেন একটি ‘দেশের বাড়ি’র খোঁজ দেখি আমরা। এই খোঁজ সেই ‘নাগালের বাইরের নীল অধঃপতন’। কত অনায়াসে তিনি সেখানে বেড়িয়ে পড়েন-“ জলের গরম আর নিঃশ্বাসের রেলইঞ্জিন, আর/ কুলকুচো, আঁশটে গন্ধের দেশে যেই/ ঘন্টা বাজলো” অমনি বীরেন্দ্রনাথ যেন বেড়িয়ে পড়েছেন তাঁর ফেলে আসা জীবন আর বুকের কাছে লুকিয়ে থাকা যাপন মেখে, ধেয়ে আসা সমইয়ের আলো ফেলে দেখে নিয়েছেন-“ নটেশাকমাখা ভাত, কাঁসা ছিল উপুড় করানো/ আঁচে, রোদমাখা গুটি বসন্তের দিনে/ভ্রমণপঞ্জিকা”। আর এখানে দাঁড়িয়েই যেন তিনি বলে উঠেছেন –“ অনেক বেড়ানো আছে, ধানশীষ , একটি শিশির/ অনেক অসম্ভব আছে।/অনেক পর্যটন আছে আরো পাখিদের শিল্পজগতে/অনেক আকাশ মাটি মানুষ মরভূ!’- কিন্তু একজন কবির আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান কি সমাপ্ত হয়? হতে পারে? তাই তো বীরেন্দ্রনাথেরও প্রশ্ন – “ আমরা কি পেয়েছি?” এ প্রশ্ন তিনি মানুষকে করেননি, কারণ জানেন বিপুল প্রবাহের ভেতরেও নিঃসংগ একক দ্বীপ হয়ে থেকে যাওয়ার এ যন্ত্রনার ,দ্রোহের , কোনো সদুত্তর মানুষের কাছে নেই, বাংলা সাহিত্যের কাছে নেই-এ প্রশ্ন তিনি করেছেন ‘আলোকলতা’ আর ‘শীতের রোদ’কে।

প্রান্তীয় ভূগোলের এক কবির কাছে এ প্রশ্ন নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার প্রশ্ন। বাংলা কবিতা বলতে আজ আমরা ভূলে যাই তার সাথে যুক্ত বিস্তীর্ণ এক ভূগোলের কথা। কোথাও যেন এক মিথ্যে কাব্যসীমা তৈরী করে দিয়েছে মহানগর আর সেখানেই কেবল নি;স্ব রিক্ত এক ব্যক্তিগত চরাচর খুঁজতে ব্যস্ত কবিরা। কেউ একবারও নিজেকে উদ্ধারের চেষ্টা  করছে না কেউ একবারও কবিতাকে কবিতার বিরুদ্ধে কথা বলাতে শেখাচ্ছে না। ‘আক্রান্ত আমি’কে নিয়ে প্রায় সারাটা কাব্যিকজীবনেই সর্বাত্মক এক পরীক্ষায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন বীরেন্দ্রনাথ।বলতেন-“বাস্তবিক, যে গোলার্ধে আলো পড়ে তার কতোরকম দর্শনীয় কারুকাজে ভরে আছে মন। পেট ভরে গিয়েছে। কিন্তু যেদিক আমার সমূহ বেঁচে থাকার যাবতীয় টেনশন, যার প্রত্যেকটি মূর্হুত-নিরবধি অস্তিত্বেরই বিপন্নতা,তাকে, অমন আঁধার স্যাঁতস্যাঁতে অস্বস্তিকর প্রতিবন্ধিতাই মুখচেয়ে, এই উপরিতলের মরুভুলোকে-ফিরে ফিরে বালুর উপর জলের লিখনশৈলীই যে প্রার্থণা করতে হয়।“...
বাংলা কবিতার উস্কানিমূলক পণ্যসর্বস্ব প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছে তাই আজও বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের মত কবিদের জীবন ও যাপনভণিতা পুষ্টি ও সমর্থণ যোগায় কিছু নতুনের আশায়। যেন প্রতিমূর্হুতের ভন্ড ও আত্মতৃপ্ত হারিয়ে যাওয়া এই বাংলা কবিতার শীতের ভোরে বীরেন্দ্র নামের কিছু কিছু কুয়াশাময় জাহাজ হঠাৎ  ভেসে আসে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে কবিতার নাড়িনক্ষত্র চেনাতে...

                                                                 (রমিত দে)



 একটি ছবি

ঐ দেখুন, কী নিঃসঙ্গ বাড়ি ।
যেন একটা দুপুরের পবিত্র দিঘিতে তার ছায়া
ক্রমশ গভীর হয়ে ফুটে উঠছে। কিন্তু কী করুণ ঐ স্থিতি !

আকাশ যেখানে ছিলো আছে ।
তবু ঐ মেঘে বেলা বহে যাওয়ার ঝঙ্কার;
এবং আবহমান যাকে ভেবে জ্বলে উঠছে নিভৃত যমুনা,
তারই দিকে তুচ্ছ এই আলোর তর্জনী
কেবলই প্রসন্ন হবে। কিন্তু কাকে পাবে?

বাড়িতে না গিয়ে যদি বাহিরের রৌদ্রে চলে যাই,
আলোর ভুবন পাবো, ভালোবাসা না হয় পাবো না।
তবু ঐ যে স্বচ্ছ স্রোত,
যার ওপর বসে কেউ দিচ্ছে করতালি,
সেই কি আনন্দ ?- আমি দ্বিধায় পীড়িত ।

ঐ দেখুন, কী নিঃসঙ্গ বাড়ি।
যেন একটা পৃথিবীর অপর প্রান্তরে তার ছায়া
ক্রমশ গভীর হয়ে ফুটে উঠছে। কিন্তু কী করুণ এই স্থিতি !

কথোপকথন

আমরা এসেছিলাম, আজো আসি – এই একভাবে আমি ও ছেলেটি
কথোপকথন করি। আমরা দুজন
এসে গেছি চকখড়ির গন্ডী থেকে ও পাড়ার দিগন্তে উধাও
অল্প-দিনে। মনে হয়, দু এক কিলোমিটার হাঁটাপথে-
আমরা দেখেছি ধূধূ ভিড়ের নির্জনতার কালো,
শুনেছি মিউজিক স্টল বাবা বলে কাঁদে এক উল্লু কাঁহাকা,
ফলের দোকান থেকে – খুব দূরে নয় যে-আপেল, তার রাঙা
অধিবৃত্তের থেকে – একটুকরো, এখনো প্রতিফলনক্রমে –
আমাদের পাওয়া হয়। আমাকে ছেলেটি এই বলে।
বলে, বাবা, আজো এসেছিলাম –গোলটি, এককামড়
                                                  খেতেখেতে দেবো।

পশ্চিমের গোলপোস্ট দিয়ে সেই আপেল অনেক বড়ো লাফ
দিতে গেলে, প্রকৃতই আমাদের খাওয়া হয়, কথোপকথন হয় আরো ।


মৃত্যুছায়ার সৈকতে

না বন্ধু, প্রেমিক হতে পারিনি এখনো।
এমন কি পাগল কিংবা দৃশ্যমান মুগ্ধ প্রকৃতির
নিজস্ব সংবাদদাতা। যদিও একদা
নিরীহ রৌদ্রের মধ্যে আকাশের সমস্ত সত্তাকে
দুই চক্ষে রেখেছিলাম আকাঙ্খার চিহ্ন দিয়ে ভরে
আজ অবশ্য এই মৃত ছায়ার সৈকতে
তাকে আর দেখেও দেখে না !

আজ বলি, বাহিরের বিশাল সমুদ্রে উন্মোচিত
বিদেশি তরঙ্গ, যার অস্পষ্ট আঘাত,আলোড়ন
রক্তের গোপন মন্ত্রে প্রতিদিন পথিক-হৃদয়
এক দিগন্তের থেকে অন্য দিগন্তের দিকে চলে,
আর এই অনাত্মীয় ঘরের নিভৃত অভিলাষ,
যা কিনা করুণ, আর ছায়াছন্ন, আর অবিশ্বাসী,
জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে আজ তারই জন্য জ্বলবে এসো !

যা ছিল সবাই তাকে স্মৃতি বলে, যেহুতু তা মৃত;
এবং যা নেই, কিংবা কোনোদিন ছিল না কোথাও-
অথচ দুঃখের মতো,আনন্দের আলোর মতন
পৃথিবীর রৌদ্রে আর রক্তে মিশে যা আজো নিহিত,
পবিত্র আগুনে তার মুখ দেখবে এসো,
এসো তুমি অসম্পূর্ণ,নিষ্প্রভ মানুষ !
কেউই তো এলো না ! দ্যাখো,দৃশ্যপটে বিপরীত আলো;
তোমার ঘনিষ্ঠ গলা কাকে ডেকে ব্যর্থ হল,দ্যাখো ।
যেমন দাঁড়িয়েছিল পুরোনো মন্দির ,বাড়িঘর,
এবং সবুজ গাছ, দুটো একটা পাখি, আর নিঃশব্দ আকাশ,
সবই রইল একাকার হয়ে এই ছায়ার সৈকতে ।


খাঁ খাঁ

কেবলি শুনতে পাই, এখনো সাড়ে তিনহাত দূরত্ব, অথবা-
একটি ছায়াছন্ন কাক, তার মাতৃভাষায় বকে চলেছে আমাকে।
প্রথমে ভাবলুম, আমি নই; তার গেছো ঐ মরদকে বলছে।
কিন্তু মরদ কোথা, সে গেছে রুটির খোঁজে,সেই তার শ্রেষ্ঠ মরদানি !
তখন ভাবছি, ওটা কাকীটার বকবকানি; প্রাচীন বায়সধর্ম

এই ভেবে , নিশ্চিন্ত বসেছি এই কবিতা লিখতে। খাঁ খাঁ দুপরবেলার
পদ্যে, কাক এসে, জল খেতে চাইছে না কি? হেসে পয়ারে বললুম,
ঐ তো কুয়োতলায় প্রকৃতি রয়েছে, যা গিয়ে বল না, জল দাও।
পদ্যের খাতিরে, নে, বাসী এই পাউরুটির দু এক টূকরো , যা ভাগ ।
কিন্তু কাকী জানলা ছেড়ে একটুও নড়লো না, না কি উড়ে গেলো বকতে বকতে ।

কবিতার দফারফা করে, যখন বসেছি চায়ে, এলো সে আবার।
এবার সন্ধ্যাভাষা ছেরে, স্পষ্ট বললো, ঢের হয়েছে, নিষ্কর্মা কোবরেজ !
হাজার বছর আগে ওরকম চুমু ছিলো না, মূর্খ, পদ্যেও ছিলো না
অমন যুদ্ধং দেহি বাগর্থ ! আমার নামে পদ্য লেখো? পরস্ত্রীকে নিয়ে?
বেড়া-বাঁধতে শেখ ব্যাটা ! সেই বেড়া- যেখানে আমরা বসে হাগি !

৩২ যোগিনী বসিবেক-৫

পায়ে পায়ে সেতুবন্ধ ভেঙে, ধরো হাত,
জোড় খুলে ও কেমন খড়ম-পায়ের শুয়ে থাকা !
শুকিয়ে আসছে জিভ শুকিয়ে হঠাৎ
কথা বন্ধ হয়ে আসে।
পা থেকে শেকড়শুদ্ধ প্রকাণ্ড গাছের আয়তন
ছায়া হয়ে স্থির হয়ে আছে-
গভীরটি এখনো প্রগাঢ়;
বলে-আরো দাও, আরো ।

পায়ে পায়ে ভেঙে, এ কী ধূপধাপগুলি ...
জলকাদা-শ্যাওলা জড়ানো ছাপ...
মনগড়া মৃত্তিকাদের এফোঁড় ওফোঁড় ঐ সাঁকো
তুলে নাও, তুলে,ধরো জলের হাতটি, তার গভীরটি রাখো।


বিবস্ত্রাকে

কী বলতে চাও,
এখন, পাকা কয়েতবেলের গন্ধেও
জিভ একটু ভারি ।

ভালো তো?
অনেকদিন পর আবার দেখা হলো;
আবার টিউব-থেকে একইঞ্চি পেস্ট দেখা দিলো ।

দেখতে , খুব ঘামে ভিজে-ওঠা মিস্তিরও অল্প;
যদি বেশি দাও,তবে যুদ্ধ কিসের।
গোগ্রাস, এখনো শুকনো ।

তবেই বলো, কে সত্য?
এই অলীক পার্টিশান, না আমরা?
একটিও জন্মদিন নেই আর ।

চেঁচামিচি করে, অমনি আয়তবান চোখদুটি
কোথাও যায় ...
যেতে থাকে রেললাইন ধরে, হলুদের ওদিকে ।

সরষেফুল , ওগো খেতমজুরদের একমাত্র ফুলেরা,
এসেছিলাম এইসবের শেষপর্যন্ত;
বিবস্ত্রাকে,সব বলা হলো।


খোদাই

কোনো এক ভিত্তিহীন কাচের আলমারির গায়ে
সূর্যকিরণ যেই লাগে,
কোনো-এক শিলান্যাস,শিলায় রেখেছে তেমনি এই
রোদের ভিতরকার এককণা খুদ ;

আমরা ব্যস্ত হই, ভোরের গাড়িটি ধরতে একপায়ে খাড়া।
রাস্তায় যে ভিড়, সে তো কুয়াশার;
সূর্যকাতর একটি রিক্সাঅলা,তিনচাকার ছন্দে,জরুরি
যেন তার বহুড়িতে আসে,যায়-বড়জোর এক নিঃশ্বাসে।

থেকে যায়-রাস্তা-পার হওয়া অমনি সবই;
সূর্যকিরণে সেই রিক্সাঅলা, তার সে সওয়ারি
নামিয়ে তুলেছে যেই অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে-
ব্যস্তসমস্ত আমরা, মন দিই কিরণ খোদাইয়ে !


ভেলা

এই তো উপত্যকা, প্রকৃত বয়ঃসন্ধি । তার কোনখানে
বসবে, ঢালের মুখে ? একদিন শুয়েছিলে না কি
ইহজন্মের মতো; তখন, পর্বত ভেঙে নদ
গড়িয়ে পড়ছে, তার বেগ ও দূরত্ব,স্তনবৃন্তে ছিলো না,
জল ছিলো, স্থলপদ্ম তখনো ঘুমিয়েছিলো জলে,
তখন শরীর,সবে স্নাত হয়ে ভোরের কল্পনা
মিলিয়ে নিচ্ছে, আর বৃষ্টিধরা-গলায় বলছে থমথমে...
সেই তো প্রথম দেখা আমাদের, দ্বিধায় মাঝখানে ।

দ্বিধায় না জলেস্থলে,আমরা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট জ্বলে উঠছিলাম,
আর অগ্নিগর্ভ , একা পৃথিবীর এফোঁড়-ওফোঁড়
রূপ, যেন ছিন্নশির সূর্যাস্ত,পাহাড়তলী থেকে
আমাদের ডেকে গেলো, মনে হলো , মৃত্যু হয়েছে;
এ-দীর্ঘশয়ান ভেলা যেখানে ভিড়বে, সেই ঘাট-
এখন আরেক জন্ম স্থলপদ্মের মতো থাক এই বুকে ।


শাদা কাগজের সঙ্গে ব্যবহার

শাদা কাগজের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি,
নখের আঁচড়ে শূন্য চিড় খায়, খেলনা তো এমনি।
তবু এই রৌদ্রময় তিনদিকে উদ্ভাস
কিছু আছে, বাঁচা নেই, ছিলো না কখনো ;
বসে আছো, যেমন সবাই থাকে- ছায়া দিয়ে রহস্য জড়ানো
এই থাক ।

আমি ভেবে দেখি , যদি আঙুলেরও হালকা ছায়াটি
তার দিকে যায়, যদি দেওয়ালের ঝুলকালি, পুরোনো টিকটিকি
নেমে আসে,যেখানে আলোর ডুম যেখানে পোকার
মাঝখানে মৃত্যুর সংকেত,
কলমের শেষ বিন্দু দিয়ে আজ তাই-
শাদা কাগজের সঙ্গে করে যাই সদ্ব্যবহার।

চাষবাস যা-কিছু, তারই উদ্ধৃত কখনো
বেঁধেছি ফুলস্কেপে, বাঁধতে পারিনি কেবল
জলের সন্মুখভাগ,ফুটে ওঠা চাঁপা,ভেজা নরম ব্যালকনি ;
ঝুঁকে দেখি-যতোটা গভীর, লম্বা,গোল বা ঘোরানো,
আসলে মানুষই আজো যা হোক সম্ভ্রমে তার মানুষের বুকে
ঢুকে পড়ে, যেমন সর্ষের মধ্যে ভূত ।

রেখে দিয়ো হাত, শুকনো হাতের তালুতে
একমুঠো...ছিঁড়ে নেওয়া রুদ্ধ প্রকৃতি।
মনে হয়, এখনো রয়েছো বসে,যেমন সবাই থাকে একা।
মুখোমুখি,অথচ পশ্চাৎভাগই রেখেছে প্রমাণ,
অন্যসব-হয় মৃত নয়তো লুকোনো,
এমনই আসঙ্গ আজ কালি ও কলমে ।

তিনশো বছর আগে

বিকেল চারটে বেজে তিন সেকেন্ড, হঠাৎ কোকিল
উঠলো ডেকে । আর,
বালতি বালতি জল তোলা হচ্ছিলো কুয়ো থেকে
দুঃখবেলার।

এ দুটি ঘটনা আজ যেভাবে ঘটলো-
ঠিক সেই ভাবে
অ্যালার্ম উঠেছে বেজে জল তোলা হচ্ছে যখন ...

এককাপ চা ও একজন
বাইরের লোক; এই অল্প ছায়ায়...
সে, লম্বা চুমুক দিতে হয়তো তখনো
রাজী নয়; তাই –

যেমন জুড়িয়ে যায়, তেমনি হয়ে এলো
দুধ-ছাড়া লিকার...
ক্রমাগত ঠান্ডা আর কালো হয়ে ,ফুড়ুৎ যখন ।

জল তোলা হচ্ছে এবং তার তীব্র পঞ্চম
তিনশো বছর আগে,অমনি তাকে ডেকেছিলো নাকি
জলের ভিতর,বাংলাদেশে ?


আবিষ্কার

হাওয়ায় রেখো না হাত, আগুনে,অথবা অঙ্গীকারে ।

দুচোখ যা দেখে, সেই দৃশ্যের ভিতর
এনো না রক্তের চিহ্ন; বরং, বেদনা
যদি থাকে-জ্বলুক সে, যতোক্ষণ সূর্যাস্তের স্মৃতি জাগে,জ্বলে ;

এই যে একার শান্তি, সমাধির নির্জন শিয়র;
তারই আশেপাশে সব সময়
গম্ভীর গাছের ছায়া, আর অন্ধকার । অন্ধকার ।
ছায়ায় থেমো না, যদি যাত্রার বিষাদে বুক ভরে ওঠে-
শূন্যতার স্বরলিপি দিয়ে বেঁধো বিচিত্র আকাশ ।

হাতের প্রথম মুদ্রা প্রার্থনার; দ্বিতীয়-দুঃখের;
এবং তৃতীয় সেই সমাহিত মৃতের তর্জনী;
একদা লক্ষ্যের লীলা যাকে কেন্দ্র করে
জেনেছে তৃষ্ণার জন্ম যৌবনের যন্ত্রনার দিকে;
দিগন্তে সে আজ আবিষ্কৃত !

হাওয়ায় রেখো না হাত,আগুনে ,অথবা অঙ্গীকারে ।

আঁচড়-১

এসো, গল্প ফাঁদি। খুচরো নেই? পরে, এই এক খোঁটা
জীয়নো থাকবে; ওর পিছল আঁশের একটি চিহ্ন থাক ।
থাক না, গল্পের চেয়ে কে বড়ো? হয়তো ভেঙে-ওঠা
ঘুমের জগত, ঐ বিশুদ্ধ থানের মাড়,ঝকমকে হাসিই শুধু বড়ো।

ফুড়িয়ে যাছো, সে কার জন্য? বয়ামের কাচ ওরে তেল ও মশলা,
জিভ খসে থাক,তবু সত্যের এই তো এক রূপ; দেখি বা না-দেখি...
এই তো, ডালিমদানা ফেটে যাচ্ছে, ভরদুপুর ফাটা
পা দুটি ,সব থেকে আরো আলগা হয়ে,পড়ে আছে। দু এক পশলা

আজ তারই দিকে শুধু তার দিকে; প্রাণ গল্পের কাঠামো খুলে এলো ।



৩২ যোগিনী বসিবেক-৪

নীলিমাদের আরো আকাশ, আরো –
একটি মহাগ্রন্থ তার পাতার ফড়ফড়ানি,
উঠেছে হাওয়া এলোচুলের মধ্যে
পাতা উল্টায় বই হাতে বনানী ।

যেখানে ছিলো রাখা একটি শূন্য ঘট ভাঙা,
মাটির বাড়ি ধুলাবাড়ির পাশে।
বসেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ইটপাথরে...
এখন দেখি তৃতীয়বাড়ি প্রায় শেষ আকাশে ।

কার সে বাড়ি তিনশূন্যের কাপাস দিয়ে ছাওয়া,
উপুড় করে রাখা মাটির ঘটভরা ঘটনা;
তারই পাশের জোহ্নাবাড়ি ...আমি বাস্তুহারা,
তিনকাল হারিয়ে আমার বাস্তু তো হলো না !

৩২ যোগিনী বসিবেক-১

শরীর কি নিজের হয়, কখনো হয়েছে? গা-গতরে
পসরা সাজানো আর ঝুলে-থাকা অশরীর দিকে ।
বিরুদ্ধের দিক-দিগন্তকে যদি মুখে রক্তওঠার মুহুর্ত
বলে...তবে তৃণভূমিকার পর, সে নিরামিষাশী
কী করে বুঝলো এই মাংস আর গরম ঝোলের
মতো রোদও ... একদিন চুমুকে চুমুকে হবে শেষ।
শেষেরও কি ঐ ঘাস জল না ছোঁওয়ার অভিমান
হাজার বছর ধরে বাঁচে? বেঁচে আছেন তো শিকারী
কবি, কিন্তু সে-কেমন শব্দসর্বস্ব হয়ে বাঁচা
যেখানে পায়ের খুরও দেখা যায় না ...নিশ্চিহ্ন চলেছে মেদিনী ।


৩২ যোগিনী বসিবেক-৩

হে নিরাবয়ব শেষ, তোমাকে প্রণাম ।
এই তো তুলোর আঁশে ভরে ঘাসে দিক –
তাকে মনে হয় উঁচু ঘুম ও দুর্দয়লিঙ্গ চড়াই-উৎরাই ।
এক বিন্দু একটি নাদের আরো ভূমধ্য ছাই
ধনুকরের;যন্ত্রসংগীতে জেগে-উঠেছে পথিক,
পথ সোজা উঠে গেছে নিঃশেষ,নিরুত্তর আরো নীল-খামে ।



********************************
My Blogger Tricks

2 comments:

  1. RAMIT...tui achis bole amrao theke jete pari...theke jete paren বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত...

    ReplyDelete