Wednesday, April 13, 2016
এই
মাসের কবি - আলোক সরকার
এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের
অহংকার কবি আলোক সরকার। তাঁর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা আমাদের নেই।
এগুলো তবু না বললেই নয় যে, আলোক সরকারের জন্ম ১৯৩১ সালের ২৩শে মার্চ দক্ষিন
কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে,
হাজরার একান্নবর্তী পরিবারের কবিতার আবহাওয়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা। কবিতার
সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা ছাত্রজীবনেই। জন্মানোর পর থেকেই সাহিত্যের
প্রতি প্রবল অনুরাগ তার সাহিত্যসৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকেই তাঁর লেখনীতে নিজস্ব
ব্যক্তিত্ব আরোপ করেছে। প্রথম বই প্রকাশকাল ১৯৫০ সাল। আজ অবধি তিনি প্রায় ৩৫টি
কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। পেশাগত দিক থেকেও তিনি ছিলেন সাহিত্যেরই অধ্যাপক।
তাঁর ভালবাসার শহর কলকাতা। বিগত
২৩ টি বছর ধরে তিনি তার প্রিয় শহরের ‘আনন্দ নিকেতন’ নামের এক বহুতলের বাসিন্দা। একমাত্র
পুত্রটি প্রবাসে। নির্জন আপন কোনে স্ত্রী আর কবিতার সঙ্গে তার দিন যাপন। ভারী ফ্রেমের চশমার
আড়াল লুকোতে পারেনা অশীতিপর শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশুমনটিকে। ঠিক তাঁর কবিতারই মতো
জীবনযাপনেও অপার মায়া অনুরণিত হয় নিয়ত। তাঁর কবিতা আমাদের তন্ময় করে। আসুন
ঝাঁপ দি এবার সেই নিস্তরঙ্গ গভীরতায়।
(সোনালী
চক্রবর্তী)
জ্যোতির্ময়
আজকাল মেয়েরা অনেক ফুল কেনে। মেয়েরা
অনেক ফুল
খোঁপায় সাজায়। কিন্তু
খোঁপা থেকে ফুল তুলে নিয়ে
কার হাতে দেয় তারা?
কবে দেয়? সেই অপার্থিব
আবহমানের স্থির জ্যোতির্ময় কোথায় কেমন
করে ঘটে?
এই সব কথা যবে ভাবি,
মনে হয়
চারিদিক ছেয়ে খুব বৃষ্টি খুব কুয়াশা
নেমেছে।
বৃষ্টির ভিতরে সেই ম্লান বাড়ি,
সেইখানে অস্পষ্ট আলোয়
হাজার হাজার মুখ,
সকলেরই অভিষেক, সকলেই সোনার মুকুট
মাথায়, হীরার জামা বুকে নিয়ে আনন্দ সুরের কোলাহল।
আজকাল মেয়েরা সুন্দর করে সাজ করে। সাজ
করে বিকেলবেলায়
তারা যে কোথায় যায়;
কার কাছে যায়? সেই অপার্থিব
আবহমানের স্থির জ্যোতির্ময় কেমন
নিঃসীম লগ্নে ঘটে;
চৈত্র মাস
ইচ্ছে করছে
এখনি তার খোঁজে
বেরিয়ে পড়ি।
বাতাস গন্ধে টলটল করছে।
বাতাস বলছে
তার ছায়া - মাখান মুখ।
বাতাস বলছে
সে ঘরের সব জানালা
খুলে দিয়েছে
যাতে গন্ধ সবদিকে যায়;
বাতাস আর কিছুই বলছেনা।
বাতাস তুমি একটা কথা বল
বাতাস তুমি আর একটা কথা বল
তার কি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে,
খুব কষ্ট?
তার কষ্ট কি এখন একটু কমেছে বাতাস?
বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে
ছেলেকে
বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে সন্ধে
হয়ে গেছে অনেকক্ষণ
বাড়ি ফিরে আসেনি ছেলে।
অন্ধকারে দেখা যায়না ভালো উঁচু নিচু
আলপথ
বাবলাগাছ আকন্দফুলের গাছ।
আঙুল গোল করে ঠোঁটে রাখে চেঁচিয়ে
চেঁচিয়ে বলে নাম
শব্দ এগিয়ে যায় গুমরে গুমরে
শব্দ এগিয়ে যায় অনেকদূর- বাবা খুঁজতে
বেরিয়েছে ছেলেকে।
দু ধারের ধান কেটে নেওয়া মাঠ আলো
জ্বালিয়ে চলছে গরুর গাড়ি
মড়মড় করে উঠছে খড় সড়সড় করে উঠছে শুকনো
পাতা।
হেমন্তের শেষদিক
কুয়াশা থেমে রয়েছে চারদিকে কুয়াশা
চিরে-চিরে জ্বলছে জোনাকি।
কুয়াশা চিরে চিরে জ্বলছে দুটো চোখ-
বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে
বড়ো বড়ো দুটো পা কুয়াশা ভেঙে ভেঙে
এগোচ্ছে
ঝটপট করে উঠছে বাদুড় ককিয়ে ককিয়ে উঠছে
প্যাঁচা
লাফিয়ে উঠলো ইঁদুর সড়সড় করে উঠলো খড়।
বড়ো বড়ো দুটো পা কুয়াশা ভেঙে ভেঙে
এগোচ্ছে
বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে।
বড়ো বড়ো দুটো পা মড়মড় করে উঠছে সাপের
খোলস
আলো- জ্বালানো গোরুর গাড়ি হারিয়ে
যাচ্ছে চোখের ওপারে।
লাটিম
হারিয়ে-যাওয়া লাটিম আমি তোমার কথা
ভাবি
ঠিক তোমার কথা নয় তোমার হারিয়ে যাওয়ার
কথা।
ছিলে একদিন সারাবেলা উদ্বেগব্যাকুল
নিশীথিনী
ঠিক কখন হারিয়ে গেলে লাল রঙের লাটিম?
কতো নিঃশব্দে হারিয়ে গেলে।
কুয়াশা জড়ানো অপরানহ মিলিয়ে যাচ্ছে
আলো
কার্নিশের নিচের আলো কার্নিশের ওপরের
আলো,
সব কিছুই সরে যাচ্ছে এখন আমার মনে হয়
পেছিয়ে যাচ্ছে জানলা নীল রঙের আকাশ
মিলিয়ে আসছে কোলাহল।
সবকিছুই সরে যাচ্ছে;
লাল রঙের লাটিম
ঠিক কখন হারিয়ে গেলে?
আমার কেবল ভাবনা
শূন্যময় অন্ধকার ফেনিয়ে উঠছে অভিমান -
মিলিয়ে যাচ্ছে আলো ঠিক কখন মিলিয়ে
যাচ্ছ
লাল রঙের লাটিম?
গোধূলিবেলা
যে এসেছে
সে নিজের খেয়ালে এসেছে
তার নাম জিগেস করব না
তার পথ জিগেস করব না
কেবল তার বিদেশটুকু
তাকে তো আর এড়ান যায় না।
ছায়ায় সাজান বিদেশ
আর এপার- ওপার গন্ধ
কত ধরনের রেখা আনছে
কত ধরনের রঙ।
আর আমরা দেখছি
হিম মধুর একটা না- হওয়া।
না- হওয়া রঙ হচ্ছে রেখা হচ্ছে
না- হওয়া মুখের দিকে চাইছে গোধূলিবেলা।
সুদূর কোন নদীর পারে
গভীর অন্ধকার ভেঙে
নৌকো আর এগোতেই পারছে না।
নদীর দুই পারেই ঘন - গহন বন।
অভিশাপ
ছায়ার ভিতরে বাড়ি যত চেনা,
ছায়ার বাইরে
বাড়ি তত নয় - আজও এ- কঠিন খেলা
আমি মুখ বুজে মেনে নিই।
প্রণয়ভাষণগুলি ভুলে- থাকা,
তোমার নিকট থেকে
দূরে চলে যাওয়া - এ- যে কি কঠিন খেলা
সকলেই সহজ বুঝবে।
এমনকি নীরব মেনেছি স্রোত ভুলে - থাকা। স্পষ্টত
বসন্তকালে
ফুলের বাসর তাকে নিঃস্ব হিম অস্পন্দ
ভাবার
রীতিগুলি যথাযথ জানি।
যন্ত্রণা কেবল মূক যন্ত্রণাহীনতা। আজ
অনির্দেশ দূরে
যত বাঁশি বাজে যত শঙ্খধ্বনি আমি অমলিন
ছায়াম্লান সিঁড়ির ওপারে।
চলে যাই। শুধু দু-
একটি হাত নড়ে, শুধু পক্ষপাতহীন
সজল চোখের তাপ - আজো এ নিস্পন্দ
অভিশাপ
আমি মুখ নিচু মেনে নিই।
শেষ চিঠি
এটাই তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি।
শীতের সকালবেলা
তুমি যেমন দেখেছ
আমাদের বাড়ির উঠোনে অনেক শালিক এসেছে।
একটু পরে গাড়ি আসবে
আমি আমার পুরোনো বাড়িতে ফিরে যাব।
তিরিশ বছর পরে ফিরে যাওয়া।
তোমার পুরোনো বাড়িতে
কতদিন আগেই ফিরে গেছ তুমি।
দুটো পুরোনো বাড়িতে
কোন যোগাযোগ হয়না।
সে তো তুমি জানই।
যোগাযোগ হতে গেলে
দুজনের জন্যেই একটা নতুন বাড়ি চাই।
তোমার পুরোনো বাড়ি থেকে
আমাকে কোন চিঠি পাঠাওনি।
তার জন্যে
ওই মাঝে-মাঝে কেবল একটু
সাদা রঙের হিম হিম।
এটাই তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি।
ধ্যানশ্রী
জল
জলের মতো।
হাওয়া হাওয়ার মতো।
আমার লক্ষ্য কারও মতো নয়।
যা কারো মতো নয়
ভাষা কি তা বলতে পারে?
ভাষা তো অর্থের প্রতীক।
লক্ষ্যের কোনো প্রতীক নেই
দেদীপ্যমান উচ্চারণ নেই
একটা অস্বীকার পর্যন্ত নেই।
সে যা সে কেবল সেইটুকু।
একটা থাকা অনিবার্য সর্বময় থাকা।
একটা ধ্যানশ্রী
আর আমার সাষ্টাঙ্গ প্রণাম।
অনুপস্থিত
এই ফল
এই ফুল
চোখের আড়ালে
নিজেকে দ্বিতীয় করছে।
থমথম বর্ষপ্রহর -
জল কাজ করছে
হাওয়া কাজ করছে।
দুপুরের আলোর রঙ
বিকেল হওয়ার আগেই
দ্বিতীয় হল।
কখন হল? কোথায় হল?
একটু করে শব্দ হল না;
ভাবতে বসলে থই পাওয়া যায়না।
মূক শাসন অদৃশ্য দিকনির্দেশ
এত অমোঘ; গোপন ঘরে
ফিরে আসি
থমথম অনুপস্থিতি ফুল ফোটার শব্দ
ফল হওয়া অনাবশ্যক। সারা
ঘর জুড়ে
অনাবশ্যক -শব্দই নেই তার আবার বাক্য
ধ্বনিই নেই তার আবার সঙ্গীতলহরী।
স্থিতি অস্থিতি
দেখার আগ্রহ
কোথায় দাঁড়িয়ে দেখছো?
পরিমাপ কর -
উচ্চতা মাপ
নিম্নতা মাপ
তারও বেশি নিজের অবস্থান।
অবস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে?
অবস্থান আঁধার পরিক্রমা ;
দৃশ্য থেকে তার ব্যাবধান
প্রত্যাশিত? নিরভিযোগ।
অভিযোগ অপ্রাপ্তি
অর্থাৎ দোলাচল।
দৃশ্য আর দ্রষ্টা
দ্রষ্টা দৃশ্যকে নির্মাণ করে
দৃশ্য দ্রষ্টাকে।
এই সব অনতিক্রম্য
তার স্থিতি অস্থিতি
(ঋণ
: রমিত দে, সুতান)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment