Wednesday, April 13, 2016
আশির অন্যতম কবি , প্রাবন্ধিক তার সাথে একজন বড় পাঠক(হ্যাঁ
আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে একজন মননশীল পাঠক পাওয়া আমাদের কাছে অনেক) উমাপদ কর তাঁর কিছু ভালোলাগার বই সম্পর্কে আমাদের যা জানালেন।এখানেই শেষ নয়। আরও আছে।
বই দেওয়া আমার কাছে শ্রেষ্ঠ
উপহার। তো, এমন বেশ কিছু উপহার আমি পেয়েছি এবারের লিট্ল ম্যাগাজিন ও বই মেলায়।
পেয়েছি আরও কিছু সোর্সে। অগ্রজ অনুজ আর বন্ধুরা ভালোবেসে তাঁদের প্রকাশিত বই আমার
হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন সেগুলি পড়ছি। পড়তে থাকবো। ভালোলাগা ও আনন্দ ভাগ করে নিলে
বাড়ে। রোজই সূর্য অস্ত যায়। কোনও দিন সে ভালো লাগাতে লাগাতে ডুবতে থাকে। তখনই সেই
অপার কে পাশের কাউকে দেখাতে বড় লোভ জাগে ইচ্ছে হয়। তাই এই কলম। না, কোনও মূল্যায়ণ বা রিভিউ নয়। স্রেফ ভালো
লাগা আর বেজে ওঠাটুকু।
@
প্রণয়ধ্বনির
সফট্ওয়ার।। বারীন ঘোষাল।। (এখন বাংলা কবিতার কাগজ)
ধরা যাক, “চাঁদ আজকে হাফপ্যান্ট
পড়েছে”। ধরলেই চাঁদ হয়ে গেলো ‘খোকা চাঁদ’। ‘বুড়ো চন্দ্রের’ গপ্পো তো জানাই।
‘নিষ্ঠুর চতুর হাসি তার’। ‘গুঁড়ি মেরে’ ‘পৃথিবীর পাঁজরের কাছে’ চলে আসছে সে। আর
সেই ‘থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা’ ‘চোখ পালটায়ে’ যে প্রশ্ন ছুঁড়েছিল—‘বুড়ি চাঁদ গেছে
বুঝি বেনোজলে ভেসে?’। ‘কালীদহে’ ‘বুড়ি চাঁদটারে’ পার করে দেওয়ার সিনটাও আমাদের
জানা। এরই মধ্যে কি আমরা লক্ষ যোজন সময় পেরিয়ে এলাম? পরিসরকে আপাত স্ট্যাটিক ধরলেও
সময়ের আলোগতিতে এবারে ‘খোকা চাঁদে’র ‘নড়বড়ে হাঁটা’, ‘আন্তর্জাল আর হাহাকার’-এ
‘লুকোচুরি’ খেলা আমরা তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করি ‘প্রণয়ধ্বনির সফট্ওয়ার’-এ। এই
বই-এরই একটি কবিতাংশ---
আলোর ইকো
আলোদের মধ্যে যারা ইকোনো
যাদের বিষয় হৃদয়
পান্ডুলিপি মেঘ মলাটে বাইন্ডিং করা
ভেতরে ভেতরেই ভিজে যাচ্ছে সুলতা
বৃষ্টিত দোরগোড়
আলোর ইকোই তো দেখালো এসব গথিকের ঘর
শব্দ করে না যে শব্দ
@
৯ আঁকা ০।। সব্যসাচী হাজরা।। (অ্যাশট্রে প্রকাশনী)
ভাবছি একটা আফ্রিকান ড্রামস্-জ্যাজ বাজছে। ভাবতে ভাবতেই
শুনতে পাচ্ছি তার বিট। দুলছি। তরঙ্গায়িত হচ্ছি। শব্দ ধ্বনি হচ্ছে আমার মধ্যে।
ধ্বনি জন্ম দিচ্ছে অনুরণন। আমি বুঁদ হচ্ছি যেমন, দৃশ্য ভেসে উঠছে মণিকোঠায়। দৃশ্যে
মাতোয়ারা হতে যাবো, ভেঙে যাচ্ছে। না, ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে আদতে সিফট্ করে যাচ্ছে।
নোঙর ফেলতে দিচ্ছে না। গতি। চারপাশ সঙ্গে চলেছে। আমি বেগে না ছুটলে দৃশ্যান্তরগুলো
দেখতে পাবো না। মিস করে ফেলব অদেখা মানুষ আর তাদের ভাবগতিক, যাপন কৌশল। দৌড় দৌড়।
দাঁড়াবো যখন, দেখবো—আমি শব্দ লোফালুফির ধ্বনি, চিত্র, আর গতিতে মোহমুগ্ধ। ও হো।
সব্যসাচীর কবিতারা। ব্রেভো।
এই বই এর একটি কবিতা---
ছবিকিংকর
রেসিস্ট
বিছিয়ে আনছি আলোকিংকর। শ্রী থেকে চিহ্নবারে যাবে না শ্রীতমা
যাবে না অন্ধকার ধ’রে। এত গনধ্বনি এত রুমকি রুমকি ডাক! সমান্তরাল বৌ সাঁওতাল হয়ে
নামে গ্রাম্য বরাবর। অক্ষ বরাবর রুখিয়ে দাও শাল, কালো হোক আলোকিংকর।
সেক্সিস্ট
দেখি নি বাবু বুকের ডিসেম্বর, রত্না নামে প্রিয়ংকর থেকে।
প্রিয় অংক থেকে লিঙ্গ খসে যায়!
স্যাডিস্ট
ট্রেস রাখো নি সই। মানুষের উপর উল্লেখ ক’রে নদী অনুল্লেখ
হল। ছায়ান্তরে ছুটে যাচ্ছে বৌ। নিদ্রাশীতে ছায়াতিমি। উদ্বেগসহ বোধনসহ রামকিংকর
তালতলা ছেড়ে ডে টু ডে নিমের হল। প্যানোরামার হল ছবিকিংকর।
@
ঘষা কাচের প্রলাপ।। উৎপল দে।। (পাঠক)
আমি কবি উৎপল দে কে ভুলিনি। ভুলিনি আটের দশকের গোড়ায় সে
আমার কাশিমবাজারের বাড়িতে গিয়ে একগুচ্ছ কবিতা শুনিয়ে এসেছিল। কী সব মায়াময় কবিতা,
শব্দের ডানা ঝটপটানোয়। ভুলিনি, ‘অন্যদ্রাঘিমা’ নামে সে এক অন্যরকমের পত্রিকা করত।
আর সেই পত্রিকায় সে ছেপেছিল ‘ছাব্বিশ’ নামে আমার একটি দীর্ঘ কবিতা। তখন অনেক
সম্পাদকই আমার উল্টোপাল্টা কবিতা তেমন ছাপতে চাইত না। পত্রিকাটি সে চালাতে পারেনি
বেশিদিন। শুরু হয়েছিল নিজস্ব স্বেচ্ছা অজ্ঞাতবাস। কিন্তু কবিতারা থেকেই যায়। হোক
না সে প্রলাপ। হোক ঘষা কাচের। জানি, নাগরিক যাপনের বিপ্রতীপে কম পলিউশনের গ্রাম
উৎপলকে অক্সিজেন যোগায় বাঁচায় ও কবিতায়। জানি, মূলধারার মধ্যে থেকেও সে কবিতায়
নিজেকে আলাদা করার কথা ভাবে। জানি, জগৎ ও যন্ত্রনা তাঁর কবিতায় ‘শুধু পোকামাকড়ের
গান’। জানি, বিষাদ মাধুর্য্যও—‘নিজেকে সেলাই করে রাখি—ছুঁচের যাওয়া ও আসাতে’। উৎপল
হাঁটলে, ‘হাঁটাপথ যুধিষ্টির হয়’। আর ‘ফয়সালা কাঁধ বেয়ে পিরামিড’।
তাঁর এই বই-এর একটি কবিতা।
স্বাদ
চাঁদ উল্টে রয়েছে... তরমুজ যেভাবে কুয়োয় খুঁজে পায় কৌশল
কলাবাগানের ওপাশ, ভিক্ষায় ভরা। গত জন্মের। লাল হয়ে ওঠা আঁচ
আর ভুল ফুঁ দেওয়া নিমের পাচন— গলায় নামছে... নেশা।
বাঁকা মুঠোয় ভর্তি ঘি। আঙুল উঠছে না। অসাড়...
পাখির নিরুদ্দেশ-ফেলা ম্যাপ, কেউই পায় না
শুধু উকুনের যাতায়াত থাকে... গর্ত ফেলে রাখা জ্যোৎস্নার
হামাগুঁড়ি ভেজা।
@
অ্যাসাইলাম।। সৌমিত্র সেনগুপ্ত।।
(নতুন কবিতা প্রকাশনী)
কখনও তার কেটে যায়। কোথাও তার
কেটে যায়। স্বাভাবিক চলে চলায়। যাপনে। বাজতে পারে না। বাজাতে পারে না। নিয়ন আলো
চকিতে ফেড-আউট। উদাস, ফ্যালফ্যালিয়ে তাকানোয় বহুদূরের ক্যানভাসে সারি সারি ক্ষুদে
পিঁপড়ের চলন। ব্ল্যাঙ্ক তাকেও বঞ্চিত করতে চায়। আমার কখনো কখনো এমন অবস্থা হয়। আমি
ফিল করি। এসবই বাহ্যিক অবস্থা। ভেতরের আনচান বোঝানো যায় না। নিজেও সবটা বুঝতে পারি
না। মনখারাপের গাত্রোত্থান সম্ভবত সেখান থেকেই। মনে হয়, তখন স্পর্শকাতর একটি
সত্ত্বা সংবেদনশীল অথচ ভাঙা একটি অস্তিত্ব এমনই লেখে--- ‘আলো পেরিয়ে আঁধারের আরো
কাছে/ ধারাপাতের ঝিলিকে আবর্ত থেকে এই অ্যাসাইলাম’। বা ‘যেভাবে অসমাপিকায় শেষ
হচ্ছে অ্যাসাইলাম/ আর ডাক দিচ্ছে সমস্ত ডেকেআনাদের’। কিংবা ‘কেউ কি চোখ বুজে আছে/
কেউ কি দেখছে তীরচিহ্নগুলো কখন অ্যাসাইলাম হয়ে গেল’। এ তো আমারই ভাবনা। আমারই বলার কথা। সেভাবে
ভাবতে বা বলতে পারিনি। সৌমিত্র প্রথম ভাবিয়ে বাজিয়ে দিল। অকারণ মনখারাপের আলতো
বিষাদকে প্রেম সরণীর পাশে সারি সারি হেসো ফুলগাছ বানিয়ে দেওয়ার দক্ষতাও সে আমায়
দেখিয়ে দিল অ্যাসাইলাম ঘিরে। ‘বলো/ বলো ‘আমি’ শব্দের অনুরণনে এখনো কতটা রয়ে গেছে/ তোমার
নাম’। এ-সবই আমার মধ্যে হতে থাকবে। কবিতার অপর নাম তো শুশ্রূষাও হয় কখনও। কিন্তু
ভাষাটা? ভাষাটা সৌমিত্রকে আলাদা করে চেনাবে। সেলাম, বন্ধু।
বইটির একটি কবিতা
২২
ভিজে উঠছি নিস্তব্ধতায়
আর উত্তরের বাতাসে ঘর খুঁজে নিচ্ছে কোলাজ
সোপান লিখতে ঠিক যতটা মেঘ
যেটুকু কৌতুকে আলগা হয়ে আসে চৌকাঠে বসা কব্জাগুলো
তেতলার বারান্দা
হিরোসিমা
চারিত্রিক কার্টুনরা
কেউ আকাশ আঁকছে তোমাকে
শরীরী ভাঁজে শুধু তুমিই – অ্যাসাইলাম
পেপারক্রাফ্ট
ব্রেস্টফেড
স্যাটায়ার হতে হতে যেভাবে সমীচীন লাগছে উষ্ণতাসমূহ
আবিষ্কার
নগ্নতা ও আমার যাবতীয়
কাছে এসো
এবার বল কি নামে ডাকবো তোমার চরিত্রদের
(প্রার্থনা করি তুমি দ্রুত সেরে ওঠো, আর লেখাটা পড়ো)
@
ডাকবাংলো ।। মাসুদার রহমান ।। (আরক, বরিশাল)
বাতাসকে বাতাস দোলা দেয়। জলকে জল ছলাৎ দেয়। মাধুরী কবিতাকে
মাধুরীর সাথে সাথে দেয় অতল। তখনই ডুবে পড়তে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে একবার ছুঁয়ে আসি
গভীরে। মণি-মুক্তা হয়ে যাই। কেলাসিত হয়ে পড়া আমার মধ্যে তখন এক জায়মানতা কাজ করতে
থাকে। কবিতার কাছে ঋণী হয়ে পড়ি। এত বৈভব তার। এত ইঙ্গিতময়তা। এক টুকরো বই আমাকে কত
ফার্লং দূরে যে নিয়ে যায়। আর আবেশিত করে ফেলে। ভাবনার রাজ্যে এক ডাকবাংলোর
চিত্ররূপময়তা আমাকে বহু দর্শায়। দেখি তো সবাই। কিন্তু এ এক এমন দেখানো যাতে পরতের
পর পরত বহুমুখ খুলে ধরে। তখন সমতালে বেজে ওঠা। সমলয়ে ঘূর্ণন। আর মাধুরীর যে দ্বিত
রূপ সে দেখালো মাসুদার। ‘দুপুরের বনের মধ্যে বিকেলের ছায়া দুলে আছে/ অদ্ভুত
নির্জনতা/ পাখিদের চুপচাপ!’ যদি একটি তন্ময়তার মাধুরী, তাহলে ‘কাটা মুরগির পাশে
ইস্পাতের ছুরি; তার রক্তমাখা জিহ্বার দিকে/ তাকিয়ে রয়েছে দাঁড়কাক’ এক কুচি ভয়ার্ত
মাধুরী। ‘শুকনো পাতার ওপরে গিরগিটির ছুটে যাওয়া’ বা ‘মাউথঅর্গান বাজানো পাখি
ডাকছে; দূর পৃথিবীতে/ হারিয়ে যাওয়া/ সন্ধ্যা নামের এক পড়শি বোনকে’ যদি নিমগ্নতা
ভাঙাকে অতলান্ত মাধুর্যে ভরিয়ে তোলে, তাহলে ‘কাঁপছে বাতাসে উঁচু ঘাসবন/ সাপের
জিভের জেরক্স’ কিংবা ‘ঘুমিয়ে পড়ার পর মেয়েটিকে/ নিজ হাতে নৃশংস খুন করবো আমি’ এক
অনির্নিত সম্ভাবনার মাধুর্য। অসাধারণ। সহজ কথায় কবিতা করার কঠিন কাজটির পারঙ্গমতা
আমি শিখে নেব একদিন। মিত মাসুদার। ভাই আমার।
বইটির একটি কবিতা।
৬
অ্যালানপোর কালো বিড়াল অন্ধকারে
লাফ দিলো
দোলক চেয়ারখানা দুলিও না। মোম আনো।
রাইটিং টেবিলের উপর দেয়াশলাই। আগুন জ্বালাতে গিয়ে
গোঁফ পুড়ে গেছে
ডাবল জানালা খোলা। একটানা ঝিঁঝিঁকথা।
পড়ে আছে কবির পান্ডুলিপি... চাঁদের গরল
@
বোতামের কারুকাজ ।। শমীক ষাণ্নিগ্রাহী ।। (এখন বাংলা কবিতার
কাগজ)
একটি বিন্দু। তাকে ঘিরে একটা গোল। গোল স্পেসটার মধ্যে যত
বিন্দু সবাই সেই বিন্দুটিকে দেখছে। আবার সেই একটি বিন্দুও সব বিন্দুর দিকে দেখছে
আর ঘুরছে। কেন্দ্রের বাইরে থেকে কেন্দ্রকে দেখা। আবার কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রের
বাইরে দেখার নিরবধি। দুরকম দেখাই কবিতার হাড়-মাস-মজ্জা হতে পারে। প্রায়ই দেখি যে
কোনও একরকম দেখায় কবিতাটি নির্মিত। কদাচ দেখা যায় দুরকম দেখাই পাশাপাশি চলছে। কখনও
ওভারল্যাপিং। কখনও তীরচিহ্ন তৈরি করে মিলে যাওয়া। এই কদাচ কাজটাই শমীক আমাকে
অনেকদিন ধরে করে দেখাচ্ছে। ‘পায়ের ভেতরে আমি/ আমার ভেতরে সে# জুতোর মধ্যে
ক্লান্তি/ রাস্তাবিষয়ক’। এ তো গেলো শরীর। আর প্রাণ? একেকটি বিন্দু জাগিয়ে তোলা হল। প্রাণ পেলো কবিতা।
‘পাখি উড়ছে/ খাঁচার ভেতর পাখিটা.../ খাঁচার চা
র পা শে একটা ঘর/ # ঘরের ভেতর আমি ও আমার বউ’। কী হৃদয়-সুন্দর না! আর দেখানোর মধ্যে যদি আস্তে
আস্তে সব দরজা জানলা খোলা হতে থাকে তাহলে কত বিস্তৃতিই না ঘটে। অনুভূতির পরতগুলো
তখন আনন্দের হর্মোন গলাতে থাকে। আহ্লাদ পেতে থাকে খুব। ভিজিয়ে নিতে নিতে আমি
নিজেকে কবিতাময়তায় আবিষ্কার করি। বড্ড ভালোলাগায় পেয়ে বসে। জিও শমীক। আরও দেখাও
নতুন করে। আরও ভেজাও অবগাহনে।
বইটির একটি কবিতা
আব্বুলিশ
ঘোড়াদের স্বপক্ষে কয়েক মাইল
সাদামাটা কাগজে রূপকথা
পেন্সিলস্কেচের ছুঁইছুঁই বিকেল
চার্চের বাগানঘেরা
কুর্চি ফুলের গন্ধে দোল খাচ্ছে
অকারণ সূর্যাস্তে
প্রার্থনাসঙ্গীতের ঘোর কেটে যায়
ঘোড়াদের ডাকে ফিরে আসি
হাতের গল্প হাতের মধ্যে জমে থাকে
@
স্পার্ক অ্যাভিনিউ ।। অনিন্দ্য
রায় ।। (এখন বাংলা কবিতার কাগজ)
চারপাশে, উপরে নিচেও সবসময় কিছু
না কিছু হয়েই চলেছে, ঘটেই চলেছে নিজস্ব একটা গতিতে। কেউ টের পায়, কেউ পায় না। কেউ
অলস বসে থেকেও ঠাওর করতে পারে না। কেউ হাজার কাজের ভিড়েও দেখে শোনে অনুভব করে
প্রতিক্রিয়া রাখে। এই যে হয়ে চলা আর ঘটে চলা তা শুধু নিসর্গ প্রেক্ষিত নয়।
ব্যক্তির প্রেক্ষিতে জীবন যাপন সামাজিক কাঠামোটির নিরন্তর চলে চলা পরিবর্তিত হতে
থাকা। এবারে যিনি দেখছেন শুনছেন ভাবছেন অনুভব করছেন তাঁর সঙ্গে আমিও অনুরণিত হতে
পারব যদি আমার সচেতনতা আমি বাঁধা না রাখি কূপমন্ডুক করে না রাখি আর কোনও বিশেষ
ভঙ্গীকেই পাথেয় না করে ফেলি। ‘লাউডগা, অভিলাষ, পেঁচিয়ে বৃষ্টির পর জলকে কামড়াল,
কো-/ বিছানা এত হার্বাল?’। ‘কল ঝরছে কব্জা বের করে, শরীর পতাকা খোলার পর হালকা’। ‘স্বেচ্ছা...
স্বপ্নে কাস্তেটি পড়েই রইল/# পা রইল যাওয়ার আগে’। ‘বাংলার কোনো পৌনে সাতটা ফিরে
আসবার’। তো এইরকম সব পঙক্তির, বাক্যবন্ধের প্রথম পাঠে আমি আটকেও পড়ছি না আবার
উল্লসিত হয়েও পড়তে পারছি না কবিতা পেয়েছে বলে। তাহলে হচ্ছেটা কী? আমাকে হ্যামার
করছে আবার পাঠের জন্য। এ কবিতা পুনঃপাঠের দাবিদার এটা বুঝতে সময় খরচ করতে হয় নি
আমার। শ্লেষের সঙ্গে উইটি পাঞ্চ করা। মেধার সঙ্গে রস। আমি মনে করি একক উইটি ও
মেধার বিচ্ছুরণ কবিতা নয়। তাই এই মিশ্রন। ধীরে ধীরে খোলে ভান্ডার। আমি রসস্থ হতে
থাকি। আমি অনুধাবনের দোরগড়ায় ‘পেয়ালা’ হই। ‘নিজেই পিপাসা’ বুঝতে পারি। আমার পিপাসা
বাড়তে থাকে। এই তো কবিতার কাজ। সূক্ষ্ণ, দেখনদারির তোয়াক্কা না রাখা। কবি তো তার
পরিমন্ডলটাকে বাদ দিয়ে দিতে পারেন না, নস্যাত করে দিতে পারেন না তার পঞ্চইন্দ্রিয়ের
গ্রহন। সম্ভবত তাই হয়ে চলা ঘটে চলাই রসদ হয়ে ওঠে। খুব একটা উঁচু নিচু গ্রাফ নেই এই
কবিতায়, যেমন চারপাশটাও আলোড়নহীন প্রায়। আছে মিহি উচ্চারণ যার রেশ তারিয়ে তারিয়ে
উপভোগ করার। তাৎক্ষণিকতায় বিশ্বাস গড়ে তোলা এ কবিতার অভিপ্রায় নয়। আমি তাই ধীরে
ধীরে ভিজি। আর কবিতাস্নানের মজা পাই। এ এক একদম অন্যরকম অনুভূতি। ভীষণ আলাদা। ওহো
বাংলা কবিতা!ঋণী হয়ে পড়ি।
বইটির আরেকটি অংশ ‘গল্প হলেও
সত্যি’র একটি কবিতাংশ।
১০
এটুকুই ধ্বজা, কীভাবে যে ঘাস থেকে
উঠে এসেছে! একে চন্দ্রেরও আগে পিছলে পড়ছে শ্রেণির অংক। তাহলে কাঁচি বলতে
রিয়্যালিটি শো? নীচে বাঁশ সমর্থিত নির্দল, হাত থেকে তালি পড়ছে। শরীর বলতে ঐ টুকুই।
নাড়তে কুসুম আঁচের কাব্য। আমাদের ব্যান্ডপার্টিতলা, ওপথে যেতে আসতে দেখা। না বাজতে
শোনা, না কি বাজতে না শোনা? মাংসের ঐটুকু উশৃঙ্খলতা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কষ্ট কীভাবে
যে চামড়া গড়িয়ে পড়ল। কখনো ঢাকনা খুলে দেখে ফেললাম হারমোনিয়াম। ...
@
ও অদৃশ্যতা হে অনিশ্চিতি ।। মেঘ
অদিতি ।। (সাম্প্রতিক প্রকাশনী)
খুব চাপে আছি, মনখারাপে আছি।
বন্ধু হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে প্রায়। একটা অনিশ্চিতি কাজ করছে মনে
আশংকার বাতাবরণে। প্রিয়জনের জন্য এমনই হয়। এ সময়ে আরেক প্রিয়জনের কবিতার বই-এ
আশ্রয় খুঁজি। ‘কাউকে ছুঁতে পারি না’ নিয়ে ‘ভাষা ভুলে বসে আছি অন্ধকারে’। মাত্রা
বেড়ে গেল কি মনখারাপের? ‘আঁকতে শিখেছি তবু, মৃত্যুর দস্তানা...’। এ আমাকে কোথায়
নিয়ে যাচ্ছো মেঘ? ‘মেঘ জমেছে কিছু, বুঝি এই বপনের কাল।’ বাঁচালে। ‘একটা সেতু অন্তত
জেগে থাক/ এই মধ্যরাতে...’। বাঁচালে। বাঁচালে। ‘একটা নদী জন্ম নিচ্ছে এখন তোমার
শরীরে’। এ আমারই শরীর। আমি অনুভব করতে পারছি তার ছল-ছলাৎ। তার গতি নির্গত তাপ। আর
দিশা গমনের। মনখারাপটা ফিকে হয়ে আসছে। ‘সরল ছবির ভাঁজে লুকোনো আঁচড়ে/ তার
হাত-দুটোর নক্ষত্র হয়ে ওঠা’। এ আমারই হাত। আমি আলো পাচ্ছি। পেতে পেতে ইচ্ছে করেই
আবার সামান্য-কারণ মনখারাপে যেতে ইচ্ছে করে। করেই তো। অভিমানের একটা হালকা পাল
মৃদুমন্দ বাতাসে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ‘কেন এত নিঃস্ব কর, আমাকে নিয়ত?’। ‘জ্বর
আসে বহুবার, সে আসে না...’। শুধু কি অভিমান? ‘সংহারে তবু উঠে আসে বিষাদ’। আর ‘আমি
কি বলব/ এই দীর্ঘশ্বাস.../ এটুকু অন্তত থাক!’। হা বিষাদ। তোমাকে চুমু খেতে খেতে কত
অনায়াস পঙক্তি। অনুনাদে বাজি। প্লুত হই। এভাবে মেঘ আলো অন্ধকারের খেলায় এক
অনিশ্চিতির মধ্যেই রাখল আমাকে গোটাটা সকাল জুড়ে। কিন্তু চাপবোধটা অদৃশ্যতায় তার
ভার নিল কমিয়ে। ভালো।
বইটির একটি কবিতা।
সংহার
মগ্নসূত্রে কেউ রেখেছিল চিত্রিত দুপুর
বিস্ময়ের ঢেউমাখা মুখর জানলায়
আলগোছ ছায়া ছিল আরও কারো
এখন সংহারের বাঁক—
ছায়া থেকে খুলে যাচ্ছে গানের সুতো
বায়োস্কোপের ছবি
তীক্ষ্ণ এক অবিশ্বাসী কুশে
নদী ভেঙে উঠে আসছে স্খলনের হাসি
চেয়ে আছি দমহীন কলের পুতুল
@
আকাশচুম্বন ।। পীযূষকান্তি বিশ্বাস ।। (অভিযান পাব্লিশার্স)
অনেক সময় বেশ কিছু বলার কথা জমে যায়। জানানোর অভিলাষও জমে।
যেখানে জমে, সেখানে আলো পড়ে। প্রতিফলিত হতে চায়। সঙ্গে তাপের বিকিরণ ঘটে। জল
চুঁইয়ে নামে। বাতাস শুধুই দম নেওয়া আর ছাড়ার মধ্যে আটকে না থেকে কিছুটা এলোমেলো
বয়ে যায়। কথা যেমন সাজে গোজে, জানানোয় পেয়ে যায় বিশেষ মাত্রা। এখান থেকেই শুরু হতে
পারে কবিতা যাত্রা। একটি সংবেদনশীল আর পরিশীলিত মনন তার পাহাড়প্রমান ভারকে ফিলটার
করে করে নিগেট করে। আর দমকে বাঁধ ভেঙে না ফেলে আস্তে আস্তে সিঞ্চন শুরু করে।
কবিতার বহু স্বত্তার মধ্যে সেচের কাজটি তার বৈশিষ্ট্য আর দূরদর্শীতাকে দেখাতে
থাকে। পীযূষের জমে যাওয়ার অনেক কিছুই আমার জানা ছিল না। আবার জানাগুলো তার চরিত্র
ও চিরাচরিত রূপ বদলে আমাকে নতুন করে জানালো। কথা আর কথার কথা থাকল না। সে যখন
জমানো থেকে এক আঁজলা তোলে—‘হাড় হিমকরা ডিলিটেড ফাইলগুলো/ রিসাইকেল বিনে পড়ে আছে।’
আমি তখন অজান্তেই নিজের ল্যাপটপের রিসাইকেল বিনটা একবার দেখে নিতে চাই। অনুভব করার
চেষ্টা করি তাপমাত্রার বিষয়টা। ‘একটা দেহ রেখে/ অন্ধকার ছেড়ে যাচ্ছি’। কোথায় যে
উড়ে যাই! এত হালকা বোধ হয়। যদিও অন্ধকারের মায়া ছাড়ার প্যাথোজ তখনও আমাকে জড়িয়ে
রাখে। ‘ঘরে ফিরে গেছে সমস্ত হলুদগুলো/ সাঁঝবেলাও’। আমি সন্ধে খুঁজতে থাকি। তার রঙ
আর ঘরে ফেরার সঙ্গে নিজের ফেরার তুলনায় মাতি। খুব বেশি দিন লিখছে না পীযূষ। তবু
তার রোপওয়েতে দেখতে দেখতে চলার মজাই আলাদা। অনেক কিছু দেখায় যেমন, একেকটা ভঙ্গীতে
জানায়। আমার আগ্রহ জারি রাখা অবধারিত হয়ে পড়ে।
এই বই-এর একটি কবিতার অংশ—
ডিজিটাল
ডিজিট যোগ করে করে ডিজিটাল হচ্ছি
ডিজিটের পরে ডিজিট যোগ করে মুদ্রাস্ফীতি
মেধা পুড়িয়ে সমগ্র পরিবার খাচ্ছি
কপাল ঝরানো নুন
ভাইয়ের হাতে স্যামসুং,
বোনের বাড়ি আই-ওয়ে পার
শেয়ারে বিয়োগ হচ্ছে কোকোকোলা...
মায়ের চুড়িদার পরে মঞ্চ থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে
আমাদের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট বাপ
@
অন্তস্থ্য য় ।। অভিষেক রায়।। (শীলা লাইব্রেরী)
পঙক্তির পর পঙক্তি। মাঝে স্পেস আর স্পেস। অনেক সময়ই একটা
পঙক্তির ধার ভার অনুষঙ্গ অন্য পঙক্তিকে জড়ায় নি। প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আবার সব
পঙক্তি মিলিয়ে কবিতা। প্রায়ই মনে হচ্ছে একটি পঙক্তিও কিন্তু একটি কবিতা। তো এই
শৈলীতেই গোটা বইটি লেখা। (দু-চারটে ব্যতিক্রম আছে)। ‘বিবেচনাহীন ছাত্রাবস্থা’য়
লেখা কবিতাগুলো বাঁধ ভাঙা আবেগ আর উচ্চকিত প্রেমাস্ফালন প্রশমিত করে ফেলেছে। এ
কেমন শিক্ষানবিশী! ভাবতে অবাক লাগে। ভালো লাগে এই ভেবে যে নিজেকে অনেকটা প্রস্তুত
করে নির্মাণে হাত দিয়েছে অভিষেক। ‘নক্ষত্রভাজন সম্পর্কটি নিয়ে কী করব ভাবছি!’
আমাকেও ভাবাচ্ছে। না, কোনও দুর্বলতার মুহূর্তে নয়। একদম স্বাভাবিক অবস্থায়। ‘কতটা
ধরতে পেরেছো আঁখের রসের সরাসরি অনুবাদ!’ সত্যিই নিজেকে ওজন করার ইচ্ছে জাগে।
‘অর্ধাহার বেচে দিচ্ছি/ পরিমিত লবণে-ই ফুটে ওঠে রান্না’। সে নিজেকে নিয়ে ভাবছে
যতটা, প্রায় ততটাই ভাবছে নিজের পরিমন্ডল নিয়ে। এ বড় আনন্দের কথা। কেননা বড় কম পাই
কিনা। কে বলবে এটা অভিষেক-এর প্রথম কবিতার বই! তার নির্মাণ দক্ষতায় আমি অভিভূত।
আমি জানি তার ‘অন্তরে বৃষ্টিপাত আরাকান শব্দে’। আর তার ভেতর জেগে থাকবে এক
‘নিরন্তর রেললাইন’। আমি উন্মুখ তাকিয়ে থাকতে রাজী আছি।
বইটির একটি কবিতা
ধর্ষণকান্ড ও মহাকাব্য
ওফ্ বারাসাত, সেই বুকে হেঁটে চল।।
অবলম্বনপ্রিয়!
মন্দিরার শরীরের শিল্পগত জমানায়
আঘাত ও বাহান্নবার সুরের বদল
সমস্তজনক আশিকী
ছিল লেগে মধ্যমপান্ডবের অঙ্গবিভায়
তুলনাহীনা রে...
(চলবে)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment