Wednesday, April 13, 2016
২০১৬-র বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কবি মাসুদার রহমানের কাব্যগ্রন্থ ডায়ালের
জাদু। কবি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি নির্বাচন করেছেন। কাব্যগ্রন্থের আদ্যপান্ত জুড়ে
যত্ন ও ভালোবাসা চোখে পড়ার মত। কবির সঙ্গে পরিচয় অল্পদিনের হলেও তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘদিনের।
মাসুসার রহমানের কবিতাগুলি আকারে ছোট কিন্তু তার ব্যাপ্তি অনেকখানি। কবিতা পাঠ শেষ
হলেও কবিতার মূর্ছনা হৃদয় ও মস্তিষ্কের কোন গোপন কুঠুরিতে যেন অনেকক্ষণ ধরে তার রেশ
রেখে যায়। তাঁর কবিতা পাঠ করে আক্রান্ত হবেন না এমন পাঠক মনে হয় পাওয়া খুব কঠিন হবে।
মাসুদার দৈনন্দিন জীবন চর্যার সামান্য বিষয়কেও তাঁর কবিতায় অনবদ্য ভাবে
উপস্থাপন করেছেন। কোথাও কোন ক্লান্তির ছাপ নেই। পরিশ্রমের ছাপ নেই। কবিতাই যেন তাঁর
কাছে এসে ধরা দেয়। কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় কবি তার কবিতার ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছেন।
তাঁর অমায়িক ঠোঁটের স্পর্শে গান গেয়ে উঠছে পাড়াগায়ের হাঁস, ধানক্ষেত, জলাজমি, হাটবাজার।
এক অভূতপূর্ব ভালোলাগায় তাঁর কবিতাগুলি মর্মে গেঁথে যায়। মাসুদারের কবিতায় রাত্রি আসে
:
"পাতা কুড়োনির মেয়ে সন্ধেবেলা
বিস্ময়ের ডালিয়া ফুল পুঁতে এলে গোধুলির পাড়ে
জোনাকি ও তারার পোষাকে রাত্রি আসবে" (কবি)
মাসুদার তাঁর কবিতায় জড়ের ওপর খুব সসহজ সাবলীলভাবে ব্যক্তিত্ব আরোপ করেছেন।
প্রায় প্রতিটি কবিতায় আমরা এর উৎকর্ষ দেখতে পাই:
"কঙ্কালের হাসিগুলি ঝুলিয়ে দিচ্ছি
তোমার শোবার ঘরে
গরমের রাত ও হাতপাখা তোমাকে
রাজপুত্তুরের গল্প শোনাবে" ( রূপকথা)
"সেই সন্ধেবেলাটি উড়ে এসে বসতে চাইছে
দুপুরের ডালে
আর দুপুর এতো বেশি হল্লাবোলে
কাক-চিলও বসতে পারে না" (আবার ছেলেবেলা)
আমরা পাঠকেরা মাঝে মাঝে ভাবি একজন কবি কখন কবিতা লেখেন। তিনি কি প্রাত্যহিকতার
মাঝে কবিতার জন্যও এক টুকরো সময় গুছিয়ে রেখেছেন। যেমনটা করতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
তাঁর অর্ধেক জীবন পড়তে গিয়ে দেখি তিনি রাতে শুতে যাওয়ার আগে নিয়ম করে কাগজ কলম নিয়ে
বসতেন। কবিতা লেখা তাঁর কাছে ছিল এক ধরনের অধ্যয়ন যার জন্য অনুশীলন আবশ্যিক বলে তিনি
মনে করতেন। মাসুদার তেমন ভাবে লেখেন কি না জানি না। তবে তাঁর কবিতা পড়ে মনে হয় তিনি
যেন আশরীর কবিতায় নিমগ্ন থাকেন। কবিতা লেখার জন্য তাঁর বিশেষ কোন সময় বাঁধা নেই। দিন
ও দিনান্তের যাবতীয় সময় জুড়ে তাঁর কবিতা যাপন।
মাসুদারের কবিতা নিমগ্ন চিত্তে পাঠের সুযোগ করে দেয়। তাঁর কবিতায় রচিত
হয়েছে এক মায়াবী জগৎ। এই জগতে দু:খ নেই। অনুশোচনা নেই। ক্রোধ নেই। বিদ্বেশ নেই। কেবল
এক ভালো লাগা ও ভালো থাকার বিস্তৃত যাপন। 'দাম্পত্য' কবিতায় কবির উপলব্ধি অবাক করে
:
"ঘুমের মধ্যে কথা বলছে বউ
ঘুরেফিরে বলছে ওর ছেড়ে আসা প্রেমিকের নাম
বলুক না
সে না হয় ঘুমের মধ্যে
আমি তো কেবল ওর জেগে থাকাটুকু
নিয়ে সুখি হতে চেয়েছি"
অযুত জোনাকি যেন তাদের স্নিগ্ধ শীতল আলোয় ভরিয়ে তুলেছে মাসুদার রহমানের
এই কাব্যগ্রন্থটি। প্রতিটি কবিতায় জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য পংক্তি যা পাঠকের মন ভালো করে
দেয়। দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে সর্বত্রগামী। শব্দের প্রয়োগে
কবি যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা যথেষ্ট ইর্ষনীয়।
অনুপম মুখোপাধ্যায় কাব্যগ্রন্থের ব্লার্বে যথার্থই লিখেছেন: " মাসুদার
হলেন সেই কবি, যিনি একটি নতুন আবিষ্কারের আনন্দ ছাড়া কোনো রচনা করেন না। তাঁর যে কোনো
কবিতাতেই বিস্ময়ের অপূর্ব শিহরণ জেগে থাকে, ঘুমোয় না, সেই শিহরণ কবির থেকে সঞ্চারিত
হয় পাঠকের পিপাসিত অন্তঃকরণে।"
মাসুদারের কবিতায় ভারত - বাংলাদেশের ভেদরেখা কোথায় যেন বিলীন হয়ে যায়।
সম্পর্ক ও সীমানার ভ্রান্ত রেখাগুলি তাঁর কবিতার সামনে মাথা নত করে। কবিতাগুলি এমন
জাদু ছড়িয়ে দেয় যার মায়াজাল থেকে বের হয়া বড় কঠিন। কিছু পংক্তি উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে
পারছি না:
"সবুজ টিয়ে হব, ফল ঠুঁকরে
সুরঙ্গ বানিয়ে
একদিন আমি তোর মনে গিয়ে বসবো" (পাখি)
কে যেন আকাশ কেঁচে শুকোতে দিয়েছে
পৃথিবীর মাথার উপর" (সকাল)
"দূর গ্রামের মাথায় যেন কারও মনখারাপ চাঁদ হয়ে ওঠে
আর সব বক্রতা আলোর জোনাকি" (রাত পাহারার কবি)
"... চটিজোড়া হয়তো কোন খেয়ালি মেঘের
গতকাল ধানখেতে রাত্রি কাটিয়ে খুব ভোরে চটি খুলে আকাশে উড়েছে" (অয়াডলফ
হিটলারের ঘোড়া)
রিঙ্কু অনিমিখের করা প্রচ্ছদ অনবদ্য। আরক প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত এই
বইটির মূদ্রণ প্রমাদবিহীন যা কবিতাগুলিকে আরো সুখপাঠ্য করে তুলেছে।
(আলোচনা : মানিক সাহা)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment