Wednesday, April 13, 2016
১৩) কৌরব দেখে ফেললেন আর বারোটা বেজে গেল! কীভাবে ঘড়ির
দুটো কাঁটা ছুঁয়ে ফেলল একে অপরকে? কৌরবের থেকে আপনি কী এমন পেলেন যে আপনার
‘বারোটা’ বেজে গেল?
১৩) ' বারোটা বেজে গেল
' কথাটা যে
মজা ক'রে বলা সে
তুমি বুঝতে পেরেছ আমি জানি, তুষ্টি । আসলে আমি তো অন্যরকম কিছু লেখার বাসনা রাখতাম । তো ওই
বিষ্ণুপুরে ব'সে আমার সামনে তেমন উৎসাহী ক'রে
তোলার মত
কিছু পেতাম না । সুবো আচার্য সম্পাদিত
' টেরাকোটা ' ছিল আমার চোখের সামনে সবচেয়ে এলিট পত্রিকা । কিন্তু সেটা ছিল পাঁচমিশেলি একটা কাগজ । সেখানে যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় কিম্বা অসীম রায়-দের মত প্রণম্য গদ্যকারদের রচনা থাকতো , সুবোদা বা শৈলেশ্বরদা
( ঘোষ )-এর
কবিতা বা
গদ্য থাকতো
,তেমনি অন্যও থাকতো । বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে ভালো লাগত ভক্তি হোত কিন্তু মগজে একেবারে হুলুস্থুল ঘটিয়ে দেওয়ার মতো কিছু পেতাম না
। আমি
, আমার দাদা এবং দু'
একজন বন্ধু
'মুহূর্ত' নামে একটা পত্রিকাও করা শুরু করেছিলাম । অন্যদের সূত্রে টুকটাক কবিতার বই
দেখে , কৃত্তিবাস আর গঙ্গোত্রী পত্রিকা দেখে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর রণজিৎ দাশের ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু কৌরবের মলাট উলটে দেখলাম সে
একেবারে অন্য জগৎ । সম্পাদকীয়
, গদ্য , কবিতা
, টুকরো রচনা
, ফিলার এমনকি পুটে লেখা এক পঙক্তিও তুলকালাম ঘটিয়ে দিলো । মনে জোর এসে গেল , যে
যাই বলুক
, আমরা পারব । আমার মিনিটের কাঁটা সাইজের বোধটোধগুলো কৌরবের ওই ঘণ্টার কাঁটার সাথে জড়িয়ে গেল আর কি
। দ্যাখো তুষ্টি , এই
যা কিছু লিখলাম সবই এই পরিণত রঞ্জনের একদমই আবছা হয়ে যাওয়া কিছু স্মৃতির বিশ্লেষণ মাত্র । শেষ কৈশোর আর
সদ্য যৌবনের রঞ্জনের তৎকালীন চেতনার ভিতরে ঠিক ঠিক কি ঘটেছিলো তা নিয়ে এর বেশি লিখতে গেলে বানিয়ে বানিয়ে গপ্পো বলতে হয় । তা
আমি পারব না । এক
তো আমার স্মৃতিশক্তি প্রায় শূন্য । তারপর ওই সময়ের পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়িয়ে তার ভিতরে উঁকি দেওয়া আজ
আর বস্তুতই সম্ভব নয়
, আমার পক্ষে । যা হবে
, তা হোল কলপকরা
রঞ্জনের কচিরঞ্জন
নির্মাণ । ভেবেচিন্তে । নাহ , পারব না তুষ্টি ।
১৪) বেশ এবার নাহয় আবার পরিণত রঞ্জনের দিকে ফেরা যাক। ‘নতুন কবিতা’র বাইরে এখন যে ধরনের কবিতা লেখা হচ্ছে, তার স্পষ্ট দুটো ধারা দেখতে পাচ্ছি। এক হল অত্যন্ত জনপ্রিয় ছন্দে লেখা কিছু অবশ করা কবিতা আর দ্বিতীয় হল একটা নতুন ট্রেন্ড। এর মধ্যে অনেক নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে। কীভাবে দেখেন আপনি এখনকার কবিতাকে? এর স্থায়িত্ব বা পরিণতি সম্বন্ধে কী ভাবেন?
১৪) দ্যাখো তুষ্টি , ভাবনার
নতুনই কবিতাকে নতুন করে । এখন আমাদের ভাষাটি উচ্চারণগত ভাবেই কিছুটা ছন্দিল
। আর যে মহাবিশ্বে
আমাদের বাস , যে মহাজীবনধারায়
আমাদের বেঁচে থাকা , সেখানে প্রতিটি নড়াচড়ায় , স্থিতি অস্থিতিতে , প্রবাহে প্রভঞ্জনে , সর্বত্র নিজস্ব ছন্দ বিরাজ করে । কোন প্রত্যক্ষ জ্যামিতিক
উপস্থিতি ছাড়াই । তাকে টের পাওয়া , অনুভব করা , কবিতায় তার স্পর্শ পাওয়া খুবই জরুরী । ওই কথা , আগেও হয়তো বলেছি , যে
, ছন্দ ক্লাসে কিম্বা বারান্দায় থাকে না । থাকে কানে , মগজে । এ কোন দোষ বা গুণের
ব্যাপার নয় । যার আছে , আছে । যার নেই , নেই । চেষ্টা ক'রে
হয় না । লেখালিখির শুরুতে ব্যকরণগত ছন্দের শিক্ষা জরুরী । কারণ তা উচ্চারণের
মিতিবোধ শেখায় । তার অনুশীলন , প্রকাশের সংযম শেখায় । কিন্তু একজন কবি নিশ্চয়ই টের পান যে কোথায় এবং কখন
মিতির চেয়ে জ্যামিতি বড় হয়ে উঠছে । ভাবনার অভিযান হাত পা নাড়ছে ভাবনার পথে নয় , বাঁধা মাপের নির্দিষ্টতায় । ফলে ব্যকরণমাফিক
ছন্দের চর্চা সারাজীবনের বস্তু হতে পারে না ব'লেই আমার মনে হয় । যেখানে কবি , যে সব উচ্চারণ নির্মিত হচ্ছে তাঁর ভাবনায় , কলমকে তা
আঁকার স্বাধীনতা দিতে পারেন না , চানও না হয়তো । নির্দিষ্ট জ্যামিতিক
মাপকে রক্ষা করার নেশায় কম্প্রোমাইজ করেন আনন্দে তৃপ্তিতে । এখন , এসব তো আমি বলছি । এ দাবী তো করতে পারি
না যে এটাই হ'ল সবার কথা । আর যিনি যা লিখে
আনন্দ পাবেন , তাই লিখবেন
, সেটাই স্বাভাবিক । এবং আমি এক সামান্য পাঠক মাত্র । কিন্তু আমার আমার
পাঠ-স্বাধীনতাটি আমার কাছে যথেষ্টই মূল্যবান
। ফলে আমি কবিতার কাছে জ্যামিতি নয় , ভাবনার নতুন , প্রয়োগের
নতুন , দিগন্তে ফুলের আগুন লাগিয়ে দেওয়া নতুনেরই অপেক্ষা করব
। ওহ তুষ্টি , দিগন্ত তো বস্তুতই এক অবাস্তব পরীরেখা , মানসমূর্তি মাত্র
, তাতে আগুন লাগছে ! ফুলের আগুন, ভাবো ! যা আমার মধ্যে কল্পনা জাগায় না , কবিতা জাগায় না , সেই টেক্সট নিয়ে আমি কি করব
! আর দীর্ঘকাল যোগ্য কবিদের সঙ্গ করতে করতে আমার মত অশিক্ষিত মানুষেরও
চট ক'রে অবাক হওয়ার অভ্যেসটাই চলে যায় । ভাবো ক্রিকেট মাঠের
মধ্যে , গ্যালারী ঘেরা বিশাল সবুজের মাঝে
, কেউ যদি প্র্যাক্টিশিং নেট বসিয়ে খেলাটা চালিয়ে যেতে চান সে তো তাঁর
স্বাধীনতা । কিন্তু আমি তো আমার বাড়ি চলে যাওয়ার স্বাধীনতাটুকু আশা করতে পারি ! তাতে কোনরকম ক্রিয়েটিভ সাম্প্রদায়িকতা আমাকে
তাড়া করবে না এই আশাটুকু করতে পারি তো , না কি ! যারা কবিতায় নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষায় মেতে রয়েছেন , যা আগে ভাবিনি , কল্পনায় আসে নি এমন সব অনুভব-নির্মাণের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের লেখায় , আমার
সকল গান শেষ অব্দি তাঁদেরই লক্ষ্য ক'রে । নাহ তুষ্টি , আলাদা ক'রে কোন নাম উচ্চারণ
করব না । অনেকেই অসাধারণ কাজ করছেন । মেনে নিচ্ছি যে পরীক্ষা
নিরীক্ষা থাকে , তার ভানও থাকে । বিপ্লব থাকে , তার ভানও থাকে । আমাকে দেখুন আমাকে
দেখুন , থাকে । এবং ভান , আসলের চেয়ে অনেক বেশি রঙচঙে । সদা পরিবর্তনশীল
এ জগতে স্থায়িত্ব এক আপেক্ষিক ধারণা , তুষ্টি । তবে যে তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
, সব গাছ ছাড়িয়ে , তাকে তো চোখে পড়বেই
, মন তো তাকে খুঁজবেই , দীর্ঘদিন , ভাবনার আলো অন্ধকারে । কোন চিৎকৃত , মুকুটিত বা ছদ্ম বিপ্লবের বিপুল আলোকসম্পাত ছাড়াই ।
১৫) জ্যামিতি বলুন আর ভান, চিনব কী করে? কেউ হয়ত
জ্যামিতিকেই কবিতা ভাবলেন, আর সেই কবিকেই তালগাছের মত দাঁড় করিয়ে দিয়ে একটা গোষ্ঠী
তৈরি করলেন। অন্যজন আরও একটা। এক কবি অন্য কবির অহং-এ কবিতার ইট ছুঁড়তে থাকলেন।
পাঠকও বিভক্ত হল। ফুলের আগুন লাগিয়ে দেওয়া দিগন্ত খুঁজতে গিয়ে পাঠক হারিয়ে যেতে
থাকল। কবিতার পাঠক এমনিতেই কম, এখন তো কবি তাঁর কাছের মানুষ ছাড়া আর পাঠক খুঁজে
পান না। তাহলে কি নিজের জন্যই লেখালেখি পড়ে রইল? ব্যক্তিগত লেখায় ভরে যাবে পৃথিবী?
১৫) যে কোন সৃষ্টি তো ব্যক্তিগতই হয় তুষ্টি । স্রষ্টা প্রথমত নিজেকে
এক অন্য আনন্দে ভরিয়ে তোলার জন্য পরিপার্শ্ব ভুলে,
নিত্যদিনের বস্তুগত অন্ধকার ও প্রাপ্তিগুলো ভুলে, নিজের মধ্যে এক অন্য আলো জ্বালাবার জন্যই কলম তুলি ছেনি-বাটালি ধরেন আর একেবারে ডুবে যান। মানে , প্রকৃত স্রষ্টাদের কথাই বলছি, আমরা তো সামান্য মানুষ। ভাবো তো, বীরভূমের ওই প্রখর রোদে, একজন মানুষ, সামান্য ফতুয়া ( খালি গায়েও ), লুঙ্গি আর বিড়ি সম্বল ক'রে, মূল
কাঠামোর গায়ে পাগলের মত সিমেন্ট-বালি-কাঁকড়ের
মিশ্রণ ছুঁড়ে ছুঁড়ে লাগাচ্ছেন 'কলের বাশি'-র ডাক শুনে এক আদিবাসী শ্রমিক পরিবারের কারখানামুখী গতি, শারীরিক প্রতিক্রিয়া আর উজ্জ্বলতাটুকু ধরবেন ব'লে। 'সাঁওতাল পরিবার'-এর ভাস্কর্যে
ছুঁতে চান মুনিষ-কামিন-তাদের বাচ্চা এবং
নিত্যসঙ্গী কুকুরটিকে, নতুন বসতের দিকে তাদের অভিযাত্রার খুশীটুকু
মাখিয়ে । কত দীন তারা, কত অভাবী, জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য শূন্য, তবু সামান্যতম পেলবতাহীন ওই চূড়ান্ত রাফ একটা আদিম উপস্থিতিতেও তাদের শরীরে
ভাস্করের খুঁজে পাওয়া ওই উজ্জ্বলতা ওই খুশীভাব-এর সামনে আমরা
আজও মুগ্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কখন যেন
"গায়ে আমার পুলক লাগে / চোখে ঘনায় ঘোর"। ভাবো তুষ্টি, ওই দিব্যোন্মাদ প্রায় ভাবসমাধির অবস্থায় একজন
রামকিংকর তার সম্ভাব্য দর্শক এবং দর্শক হারানোর কথা মাথায় রেখে কাজটি করছেন!
মাত্র চপ মুড়ি আর দেশি মদের খোরাকিতেই! ভাবা যায়!!
কল্পনা!! তারপর জীবন চলিয়া গেছে আমাদের কুড়ি কুড়ি
বছরের পার, তবু আজও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ওই সৃষ্টির সামনে। মাথা আপনিই নুয়ে
আসে, এই সেলফি-সংকুল সময়েও! ফলে, দাঁড়াল কি?
তালগাছ দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় না। আমি "তালগাছের মতো"-র কথা বলছি না কিন্তু। তো সব গাছ ছাড়িয়ে একা হয়ে ওঠা একটা স্বতোৎসার ব্যাপার, একদম একলার। এসব গোষ্ঠী আর গোষ্ঠীপতি
কিম্বা গোষ্ঠীপত্নী বানিয়ে তোলার কর্মকাণ্ড থেকে অনেক দূরের ব্যাপার। সব সৃষ্টিরই নিজস্ব
উপভোক্তা আছে। সার্বজনীন শব্দটা একটু বিভ্রান্তিকর মনে হয় এক্ষেত্রে। তেমনি সব ধরনের স্রষ্টাদেরই
একটা বিরাদরি তৈরি হয়। সবার চিন্তাতরঙ্গ সবার সাথে তো মেলে না। যাদের যেমন মেলে
তারা তেমনিভাবেই কাছাকাছি এসে পড়েন। ভাব বিনিময়, চর্চা এবং নিজের কাছে নিজে আরও স্বচ্ছ হয়ে ওঠার জন্য। ঋদ্ধির জন্য। এর মধ্যে যিনি ওই
সব গাছ ছাড়িয়ে মাথা তোলেন নিজের ভাবনা-কল্পনার অভিনবত্ব, তার প্রয়োগের নবীনতা, অধ্যবসায়, সর্বস্ব নিবেদন করা সৃষ্টিকাজের মধ্যে দিয়ে,
সমচিন্তাতরঙ্গের অন্য স্রষ্টারা তাঁর চারপাশে জড়ো হন, সংসার গুছিয়ে ওঠে ক্রমশ। হ্যাঁ, এও এক প্রকার গোষ্ঠীই বলতে পারো। তবে গোষ্ঠী-সংঘর্ষের গোষ্ঠী নিশ্চয়ই নয়। ইট ছুঁড়ে প্রচার
পেতে চান যারা, চোখে পড়তে চান খ্যাত
হতে চান অহং-এর ঘন্টা বাজিয়ে, তাঁদের নিয়ে
আলোচনা ক'রে সময় নষ্ট করা খুব জরুরী কি! আমি জানি না। একইভাবে পাঠক তৈরি হয়। সেও ওই চিন্তাতরঙ্গের
মিলমিশের ব্যাপার। সমতরঙ্গের পাঠকরাও নিজেদের মধ্যে প্রাপ্তির আনন্দ বিনিময় করেন। ভেবে দেখো তুষ্টি, সুদূরে-পরিণত সামান্য দূরে
বসে জীবনভর কাজ ক'রে, একা একা জাগতিক মরে
যাওয়া একজন স্বদেশ সেন-কে আজ কতজন কবিতাপাঠক বারেবারে আবিষ্কার
করছেন নানাভাবে। সেই পাঠকদেরও তো কবি না ভেবে আলাদা করে দেবার কথা ভাবতে পারি না
আমি। কবিতার
পাঠক চিরকালই কম। কোনদিনই তা তেলেভাজা, পিজ্জা বা বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা পায় নি। এসব জেনে মেনেই তো
কবিতা লিখতে আসা। নিজেই। কেউ কানের গোড়ায় বন্দুক ধরে নি কবিতার লেখক বা পাঠক
হওয়ার জন্য। সমাজে কবিতার বস্তুগত প্রয়োজন শূন্য। এসব জেনেই তো। তাহলে, আমি আদৌ কেন লিখব যদি একান্ত নিজের কিছু লিখতে
না চাই আমি! আমরা যখন চর্চাধারাটি শুরু করেছিলাম, বাংলায় যাকে বলে টোটাল রিজেকশন তা-ই ছিল প্রাপ্তি। 'কবিতা ক্যাম্পাস' পত্রিকা
সম্পাদনা করার সময়, ধোপা-নাপিত বন্ধ হয়ে
যাওয়া কাকে বলে দেখেছি। নিজেদের পত্রিকা আর কৌরব ছাড়া লেখার জায়গাও ছিল
না। পত্রিকা
হাতে তুলে দিলে নামী এক অগ্রজ তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন এতদূরও। লিখিত ভাবে নানারকম
বিধ্বংসী সমালোচনা, আক্রমণ
এবং আমাদের মত কবিতা-ধংসকারীদের কি কি শাস্তি হওয়া উচিৎ,
সেসবও। আমাদের বোধহয় ভূতে ধরেছিল। আমাদের কোন ভ্রূক্ষেপই
ছিল না। কোন
হতাশা, অবসাদ, খ্যাতি
দূরস্থান কোনরকম স্বীকৃতিই না পাওয়ার যন্ত্রণা এসব কিচ্ছু ছিল না, আমাদের । স্রেফ নতুন অভিযানের আনন্দে,
নিজেরা নিজেদের কাজ করে যাওয়ার আনন্দে মশগুল ছিলাম। কুড়ি বছর লেখার পরেও
আমাদের মত মহান হস্তি কিম্বা এই পরিমাণ সব বিচিত্রবীর্য তাদের যোগ্য মর্যাদা পেল না
কেন বলে কান্নাকাটি করি নি। কোন রঙিন পর্দা কিম্বা বড়দা, কোনটাই ছিল না আমাদের। খুব উপকার করেছিল
সেই অভাব। আজ দ্যাখো তুষ্টি, অন্যরকম কবিতা লেখার কত ছেলেমেয়ে, কত পত্রিকা এবং ফেসবুক। আমরা বয়স্ক হয়েছি। কিন্তু আজও আনন্দেই
আছি। কোনরকম
নেগেটিভ থিঙ্কিং পাত্তা দিই না। কোথায় কোথায় থেকে , কি কি ভাবে পাঠক গড়ে ওঠে উঠেছে উঠছে তা দেখে
ভারী কৃতজ্ঞ হয়ে থাকি । ধন্য হই । আর ভাবি , এই পরিস্থিতি পরিবেশ থেকেই, সাত-এর দশক থেকে নীরবে ওই পরিমাণ নিবেদন, পড়াশোনা, অধ্যবসায় আর সৃষ্টিকাজ দিয়ে একজন মানুষ বারীন
ঘোষাল হয়ে ওঠেন। জানি যে ওই যাপন ৫০-১০০ বছরে হয়তো এক আধজনই করে থাকেন, করতে পারেন। জানতে পারি যে, তালগাছ কিম্বা বারীন কোনটাই বানিয়ে দেওয়া যায়
না। তবে তুষ্টি, গোষ্ঠী এবং তাদের পতি বা পত্নী ও তাদের ইটগুলি ( গোটা,
আমা, ঝামা ), এদের কারও প্রতিই
আমাদের কোন বিদ্বেষ নেই। সবার মঙ্গল হোক।
১৬) কবিসঙ্গের কথা যখন বললেনই, এই কবিদের কাহিনী আপনার
কাছে জানতে চাইছি। তাঁদের লেখা দিয়ে বা তাঁদের যাপন দিয়ে - কে, কে প্রভাবিত করেছে
আপনাকে? আপনার লেখায় সেই প্রভাবের ছাপ পড়েছে কি?
১৬) সে সব কথা বলতে গেলে
তো বিরাট লিস্ট হয়ে যাবে তুষ্টি। তবে একটা কথা বলব যে নিজে যখন লিখতে বসি, বহুকালের
অভ্যাসমত চারপাশটা একদম শূন্য হয়ে যায়। কোন কিছুই আমার মাথায় থাকে না । আর আমার বিস্ময়কর
বিস্মরণপ্রতিভা এ ব্যাপারে যথেষ্টই সাহায্য করে আমাকে। তবু কোথায় কোথায় আমার লেখার
মধ্যে কে কে কি কি ভাবে রয়ে গেলেন, এ ব্যাপারে তোমরা যদি কেউ কখনও কিছু লেখো আমারও
উপকার হয়, টের পাওয়া হয় যে এগুলো আমি খেয়ালই করি নি। যে কোন ঋণের সামনে কৃতজ্ঞ হয়ে
নত হয়ে দাঁড়াতে আমার ভীষণই আনন্দ হয়। তবু, দু' এক কথা। প্রভাব যে কি কি ভাবে আসে! সে
গতজন্মের কথা প্রায়। বিষ্ণুপুরে দলমাদল কামানের পাশে ছিন্নমস্তা মন্দিরটি তখন নির্মীয়মাণ,
সমাপ্তপ্রায়। আমার অকালপ্রয়াত ছবি-আঁকিয়ে বন্ধু প্রদীপ বিশ্বাস আর আমি মাঝে মাঝে ওই
মন্দিরের হলটিতে বসে থাকতাম। তো একদিন আমরা গল্প করছি আর একজন অন্ধ মানুষ একতারা বাজিয়ে
একা একাই গান গেয়ে চলেছেন। আমাদের অত বকবকমের মধ্যেও হঠাৎ একটা লাইন কান পেরিয়ে একদম
সর্বস্বে এসে লাগলো। " আমার দেহের মধ্যে সুজন যে জন / তার ঘরেতে ঘর করেছি
"। কত ক্যালেন্ডার হারিয়ে গেল তুষ্টি, তার পর। কিন্তু এই লাইনটা বিশেষত
" সুজন " শব্দটি আজও আমায় ছাড়ে নি। খোঁচায় মাঝে সাঝে, ভাবতে বলে। সদ্য কৈশোরে
ছিলেন রবীঠাকুর। হ্যাঁ , চোথা মারতাম বৈকি। কিন্তু পেছনটি পেকে ওঠার সময়ে সামনে ছিলেন
আনন্দ বাগচী, তখন বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজে পড়াতেন। ছিলেন সুবো আচার্য, ঈশ্বর ত্রিপাঠী,
রূপাই সামন্ত। অনেক স্নেহ পেয়েছি। যা আমার মূল্যবান স্মৃতি। কিন্তু ওই যে কবিবন্ধু
স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা, তৎকালীন স্বনামধন্য ' চারণকবি বৈদ্যনাথ ', তিনি আমাকে
একটু বেশিই ভালবাসতেন, একদিন হঠাৎ বললেন যে, " তোর লেখার মাথায় যেদিন তোর নাম
লেখার প্রয়োজন ফুরোবে, সেদিনই বুঝবি কিছু করলি "। এ আমি আর কখনও ভুলতে পারলাম
না। কৌরব-এর সঙ্গে যোগাযোগ-এর পর কমল দা মানে চক্রবর্তীর একটা লেখায় পড়লাম, "
পাটক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত পড়ে আছে / সারারাত জমেছে রায়ট ওই সবুজ বিভায় "-- রায়ট
শব্দের ওই ব্যবহার আমি আগে পরে কখনও দেখি নি। ভুলিও নি। অন্ধের মত ফ্যান ছিলাম শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের। মুখস্ত থাকত কবিতা। আজ উল্লেখে যদি কোন ত্রুটি থেকে যায়, আগেই ক্ষমা
চেয়ে নিচ্ছি। একটি কবিতা শুরু হচ্ছে, " ছুটে কে তুলিলে শালবন / বাহুবন্ধন চারিধারে
", আর শেষ হচ্ছে, " কে ছুটে তুলিলে শালবন / ঘনবন্ধন চারিধারে "-- 'ছুটে
কে' থেকে 'কে ছুটে' আর 'বাহুবন্ধন' থেকে 'ঘনবন্ধন' এই জার্নিটা নিজের মত ক'রে আবিষ্কার
করার চেষ্টা করেছি কতবার। মনে পড়ছে, গভীর শীতের রাত আড়াইটে। ধলভূমগড়ের বনবাংলোর ঘরে
সবাই ঘুমোচ্ছে। আর খোলা বারান্দায় চাদর মুড়ি দিয়ে ব'সে আমি ধীমান আর প্রণবদা (দে) শুনছি
বারীনদার "সৎকার" পাঠ। সেই শিহরণ, " নাম কি / নাম কি বল বাবা / অস্ফুট
বরফ ঝরে পড়ে "-- শুনতে শুনতে চোখে জল এসে যাওয়া, ভুলি নি। গুরুপ্রতিম প্রয়াত কবি
উত্তর বসুর ওই প্যাশনেট উচ্চারণ! বন্ধুরা ধীমান চক্রবর্তী - অলোক বিশ্বাস - প্রণব পাল
- রতন দাস প্রত্যেকের কাছেই কিছু না কিছু শিখেছি। ধীমানের কবিতায় সমস্ত উচ্চারণে প্রবহমান
একধরনের উদাসীনতা অথচ এ সংসারের পরিচিত মায়া ও রহস্য থেকে অন্য আলো বার করা। আর স্বপন
রায়! টোটাল অ্যাডিকশন একখানা। খুব ভয়ে ভয়ে পড়ি আমি। হাত সুলায়। পাগলের মত ইচ্ছে করে
নকল করতে। পরবর্তী জনেদের মধ্যে অনেকেরই আমি ভক্ত পাঠক, ওরকম লিখতে পারলে নিজের পিঠ
চাপড়াতাম। একদম সাম্প্রতিকে অনুপম মুখোপাধ্যায়, নাহ কোন তাত্ত্বিক তর্ক নয়, অনুপমের
উপস্থাপনার অভিনবত্বটি একেবারেই ওর নিজস্ব, দ্বিতীয়-অসম্ভব। তুষ্টি, ঝুঁকি আর ঝাঁকি
নিয়েই তো কেটে যায় কবিতাজীবন। ঝুঁকি বলতে মনে পড়ে স্বদেশদাকে। " নতুনের কোন দুঃখ
নেই "। অমর উচ্চারণ। আকাঙ্ক্ষার দুঃখ নিয়ে, আপসোস পিছুটান নিয়ে, যে কোন মূল্যে
খ্যাতি চাই / না পেলে বাঁইচব নাই , এ সব নিয়ে তো নতুন করা বা নতুন হওয়া যায় না। আর
ঝাঁকি। কত ঝাঁকিই তো চালিয়ে নিয়ে এল এতদূর! কত বছর আগে, এক কবির দু'টি কবিতা বেরোলো
এক নামী পত্রিকায়। প্রথমটির শুরুটা এরকম, " গোলাপ বাগানে ঢুকে / কুপ্রস্তাব করেছিল
নগ্ন যুবক / বলো কে বেশি সুন্দর / তুমি, না আমার এই প্রস্ফুটিত শিশ্নমুখ " --
চমকে উঠেছিলাম যৌবনের এই চ্যালেঞ্জিং উদ্ভাসে। কিন্তু ঝাঁকি হয়ে রয়ে গেল অন্য কবিতাটির
দু'টি লাইন। " দুঃখী মানুষেরা ঠিক তত দুঃখী নয় / তাদেরও নৈশ রেডিওতে আছে কিশোরকুমার
"-- আহা। যারা এই পঙক্তি দু'টি শুধু স্যাটায়ার হিসেবে পড়েন তাঁদেরকে প্রণাম। আমাকে
তো ওই 'কিশোরকুমার শব্দটি' টানতে টানতে এক বিস্তৃত প্রান্তরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়।
জানি না স্মৃতি বেইমানি করছে কিনা। কবিতা দু'টির লেখক রণজিৎ দাশ। এ প্রসঙ্গে বলি তুষ্টি,
ঐহিক পত্রিকার সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে, রণজিৎদাকে জীবনকৃতি সম্মাননা দিতে দেখে,
আমার ভিতরে খুব একটা উত্তেজনা হচ্ছিল। এই কথাগুলোই ওখানে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লজ্জায়
সংকোচে পারি নি।
সাক্ষাৎকার ঃ তুষ্টি ভট্টাচার্য
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment